Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দূরপাল্লায় বাসের আকাল, নেপথ্যে যাত্রী সংকট-নিরাপত্তাহীনতা

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২২ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১৭

ঢাকা: হরতাল-অবরোধে এবার ঢাকার ভেতরে গণপরিবহন চলাচল প্রায় ‘স্বাভাবিক’ থাকলেও আন্তঃজেলা পরিবহনের ক্ষেত্রে চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাস চললেও পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা ‘যাত্রী সংকট’কে এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। ঢাকার বাইরে বাস ভাঙচুর, নতুন সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে শ্রমিকদের অসন্তুষ্টি ও পর্যাপ্ত পুলিশ পাহারা না থাকাকেও তারা কম পরিমাণে বাস চলাচলের কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন।

বাস মালিকদের ভাষ্য, একটি বাস ঢাকার বাইরে গেলে অন্তত ২০ হাজার টাকা খরচ রয়েছে। যাত্রী না থাকায় সেই খরচসহ আরও ক্ষতির আশঙ্কায় তারা সহজে বাস ছাড়ছেন না।

গতকাল মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা গেছে, হরতাল-অবরোধ না থাকায় যাত্রী বেশি থাকার কথা থাকলেও সেই অনুপাতে যাত্রী নেই। শ্রমিক ও মালিক পক্ষও একই কথা বলছে। তারা বলছেন, মানুষের মধ্যে এবার ‘আতঙ্ক’ বেশি থাকায় গণপরিবহন কম চলছে। ঢাকায় অবরোধ-হরতালের দিন এখন মোড়ে মোড়ে গাড়ির জটলা তৈরি হলেও ঢাকার বাইরে মহাসড়কে বাসের পরিবর্তে ছোট যানবাহন বেশি দেখা যাচ্ছে। স্বল্পদূরত্বে মিনিবাস, সিএনজি, মোটরবাইক ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় যাত্রীরা বেশি চলাচল করছেন।

ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চলাচলকারী সৌখিন পরিবহনের সুপারভাইজার রুবেল মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাড়ি চলছে, তবে তেমন যাত্রী নেই। যাত্রী হলে গাড়ি ছাড়ি। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুব খারাপ। আজ গাড়ি চলছে বেশি, যাত্রী কম। গত কয়েকদিনে মালিকসহ আমাদের ৮০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।’

তবে ওই একই বাসের চালক মাহাবুল বলেন, ‘হরতাল-অবরোধেও আমরা গাড়ি চালাচ্ছি। যাত্রী কম। আয় রোজগার কমে গেছে। আমাদের ক্ষতি হচ্ছে।’

মহাখালী বাস টার্মিনালের এনা পরিবহনের কাউন্টারের মাস্টার সুমন মাহমুদ বলেন, ‘রাজনীতির সব প্রভাব শুধু আমাদের ওপর। শ্রমিকরা গাড়ি চালাতে পারছে না। কাজ নেই। ২০ লাখ লোকের পেটে ভাত নেই। পরিবহন না চললে আমরা খাবো কি?’

তিনি আরও বলেন, ‘সব কিছুতেই পরিবহনের ওপর রাজনীতির চাপ পড়ে। হরতাল-অবরোধের দিন চার ভাগের দুই ভাগ গাড়ি চলে। এমনিতে ১২০টি গাড়ি গেলে হরতাল অবরোধে ৪০টি গাড়ি যায়। শ্রমিকদের বেতন দৈনিক, গাড়ি চললে তারা টাকা পায়। ফলে বাকি গাড়ির ভ্রাইভার, শ্রমিক ও কর্মচারীরা না খেয়ে থাকেন।’

ঢাকা জেলা মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী সদস্য মাকসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু গাড়ি চললে শ্রমিক চলে, গাড়িই চলছে না, তাই শ্রমিকের সমস্যা। এটা সবাই বুঝে। কেউ তো সমস্যার সমাধান করে না। যারা দেশ চালায়, যারা বিরোধী দল, তারা সবাই বুঝে। হরতাল-অবরোধে সব চলে কিন্তু চলে না শুধু পরিবহন। শ্রমিকরা খুব কষ্টে আছে। মালিকদেরও তো আয়ের উৎস নেই।’

মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ সভাপতি মো. শওকত আলী বাবুল বলেন, ‘গতকালও (সোমবার, হরতালের দিন) এই টার্নিনাল থেকে ১১৫টি গাড়ি ছেড়ে গেছে। অন্য সময় ঢাকা মালিক সমিতির আওতাভুক্ত ৩০০ এর মতো গাড়ি ছেড়ে যায়। অন্য জেলার গাড়িও এখান থেকে ছেড়ে যায়। সব মিলিয়ে ৫০০ গাড়ি যায়। কিন্তু এখন যাত্রী নেই, গাড়ি কম যাচ্ছে। যাত্রী না থাকলে গাড়ি যাবে কিভাবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি বাস ময়মনসিংহ পর্যন্ত গেলে ৮ হাজার টাকার তেল, সব মিলিয়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ রয়েছে। আন্তঃজেলার গাড়ি যাত্রী ছাড়া গেলে খুবই লস। আমদের সিদ্ধান্ত হলো গাড়ি যাবে, যাত্রী না থাকলে গাড়ি কি নিয়ে যাবে? আমাদের ক্ষতির শেষ নেই। প্রতি মাসে একটি গাড়ির ব্যবস্থাপনা খরচ ৪০ হাজার টাকা।’

মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তঃজেলায় বাস কম চলছে, এটা বলা যাবে না। তবে যাত্রীর সংকট, তাই গাড়ি কম চলছে। একটি বাস ঢাকার বাইরে থেকে ঘুরে এলে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা হাজার। কিন্তু এই খরচ কিভাবে মেটাবো? এমনও অনেক মালিক আছে, যার মাত্র একটি গাড়ি, তারপক্ষে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা লোকসান দেওয়া সম্ভব? তাই এখন একদিন একজনের গাড়ি চলছে, অন্যদিন আরেকজনের।’

তিনি বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে একজনের একটি গাড়ি বন্ধ থাকলে সর্বনিম্ন ৬ হাজার টাকা লোকসান হয়। এখানে মালিক সমিতির গাড়ি রয়েছে প্রায় ৭০০টি। সে হিসাবে প্রতিদিন এই টার্মিনালের আওতাভুক্ত মালিকদের ৪২ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। সারাদেশ মিলিয়ে ক্ষতি আরও অনেক বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হরতাল-অবরোধ কামনা করি না। যারা হরতাল ডাকছে তাদের মালিকানাধীন অফিসও খোলা, যারা নিরপেক্ষভাবে পরিবহন ব্যবসা করছি ক্ষতি শুধু তাদের।’

তবে শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রমিক নেতারা জানান, গত ২০ নভেম্বর হরতালের দিন বাস নিয়ে বের হয়েছিলেন ইমাম পরিবহনের চালক হুমায়ুন কবির। পথে মোটরবাইক ও বাসের দুর্ঘটনা ঘটে। এতে চালক হুমায়ুন কবির জামিন না পেলেও মোটরবাইকের চালক জামিন পেয়েছেন।

এই উদাহরণ টেনে দু’জন শ্রমিক নেতা বলেন, ‘আমরা হরতাল-অবরোধ ভেঙে রাস্তায় নামি, অথচ নতুন পরিবহন আইন হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের চালকরা জামিন পাচ্ছেন না, একই ঘটনায় অন্যরা জামিন পাচ্ছে। এটা ঠিক নয়। পরিবহন সেক্টরের অনেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থা সেই আগের মতোই। এসব কারণে শ্রমিকরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না।’

দুই শ্রমিক নেতা আরও জানান, নতুন পরিবহন আইনে চালকদের জামিন নেই। অনাদায়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এই জরিমানা শ্রমিকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। হাইড্রোলিক হর্নে আগে জরিমানা ছিলো ১০০ টাকা, এখন ১৫০০ টাকা। পূর্বে সর্বনিম্ন জরিমানা ছিলো ২০০ টাকা, এখন সেই জরিমানা ২ হাজার ৫০০ টাকা। শ্রমিকরা মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত চেয়েছিলো একজন মালিক নেতা, শ্রমিক নেতা ও বুয়েটের প্রতিনিধি দিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের পর শাস্তি। কিন্তু বর্তমানে কোন তদন্ত নেই। পুলিশের এজাহার অনুযায়ী শাস্তি হচ্ছে। এসব নিয়েও শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

শ্রমিক নেতারা আরও জানান, বিএনপির আমলেও হরতাল-অবরোধ ছিলো। আওয়ামী লীগের হারতাল-অবরোধে তখন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের বাসার পাম্প থেকে প্রতিটি বাসের জন্য বিনামূল্যে ৫০ লিটার তেল দেওয়া হতো। টার্মিনাল থেকে টোকেন দিয়ে দেওয়া হলেই ওই পাম্প থেকে তেল পাওয়া যেত। বর্তমানে সেই ব্যবস্থাও নেই। এমন কোনো ব্যবস্থা থাকলে আন্তঃজেলায় বাস বেশি চলতো বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মালিক জানান, বগুড়ায় থানার পাশেই একটি বাসে ভাঙচুর করা হয়েছে। বাসের নিরাপত্তা নেই। থানার একশ গজ দূরে গাড়ির সামনে ঢিল ছুড়ে গ্লাস ভেঙে দিয়েছে। এই গ্লাস মেরামত করতে ৪৫ হাজার টাকা লাগবে। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?


আরেকজন বাস মালিক জানান, ঢাকা থেকে হালুয়াঘাট সড়কে চলাচলকারী ‘শ্যামলী বাংলা’ নামের একটি বাস হালুয়াঘাট থেকে এসে নাবিস্কো মোড়ে রেখে চালক নাস্তা করতে গিয়েছিল। এসে দেখে গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের (মহাখালী টার্মিনাল) মালিকানাধীন ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এটা কাম্য নয়।

মালিক নেতারা আরও জানান, ঢাকার বাইরে বগুড়া, গাজীপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় আন্তঃজেলায় চলাচলকারী বাসে ঢিল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে মালিকপক্ষ আতঙ্কে রয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার যাত্রী সংকটের কারণে আন্তঃজেলায় বাস কম চলছে।’

২০১৩-১৪ সালের তুলনায় বাস কম চলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তখনকার অবস্থা বীভৎস ছিলো। প্রথমতো রাস্তায় পরিবহন চলতেই পারেনি। লাগাতার কর্মসূচি ছিলা। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। সব স্বাভাবিক। এখন রাতের বেলায় বেশি গাড়ি চলছে, দিনের বেলায় কম। এখনও রাতের বেলায় নাইট কোচে বা গাড়ি বহরের সামনে পেছনে পুলিশ থাকছে।‘

নতুন পরিবহন আইনে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ, এ কারণে পরিবহন কম চলছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরিবহন কম চলার সঙ্গে নতুন আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কোন শ্রমিক কি বলেছে, সেটা তারাই বলতে পারবে।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/এমও

আন্তঃজেলা গণপরিবহন দূরপাল্লার বাস বাস চলাচল হরতাল-অবরোধ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর