আ.লীগে পঞ্চানন-ননী দ্বৈরথ, বিএনপি-জাপায় এজাজ ও সুনীল এগিয়ে
২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১০:০১
খুলনা: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ‘সুন্দরবন’ তার একাংশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে যে জেলাটিকে সেটি খুলনা। সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের মতো অসংখ্যা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি এই খুলনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেন, বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাতসহ অসংখ্য গুণীব্যক্তির পূণ্যভূমিও এটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, খলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আবদুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য রাজনীতিক এই খুলনায় জন্ম নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত খুলনার রাজনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্তও সেই চাঙ্গাভাবের রেষ থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি ঝিমিয়ে পড়ে। মাঝে একবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছিল খুলনার রাজনীতি। তবে গোটা খুলনায় এখন রাজনীতির কোনো চমক নেই, জৌলুসও নেই। মাঝখানে তো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে রাজনীতি ফের চাঙ্গা হয়েছে।
আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা এখনও হরতাল-অবরোধ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই খুলনার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে খুলনা-১ আসনের চিত্র।
বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসন। হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকাটি আওয়ামী লীগের রিজার্ভ আসন হিসেবে পরিচিত। পুনরায় আসনটি ধরে রাখতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে দুই উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো।
এই আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের এম এ খায়ের, ১৯৭৯ সালে বিএনপির সৈয়দ মোজাহিদুর রহমান, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের শেখ হারুনুর রশিদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির শেখ আবুল হোসেন বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে এই আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হারুনুর রশিদ। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথমবার এমপি হন পঞ্চানন বিশ্বাস। ২০০১ সালে পঞ্চানন বিশ্বাস আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে ফের এমপি নির্বাচিত হন। এর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জয়লাভ করেন ননী গোপাল মণ্ডল। তবে ২০১৪ সালে ফের পঞ্চানন বিশ্বাস দলের মনোনয়ন পেয়ে জয়লাভ করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নৌকার টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন পঞ্চানন বিশ্বাস।
আওয়ামী লীগের দফতর থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, খুলনা-১ (দাকোপ -বটিয়াঘাটা) মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস, সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মন্ডল, কেন্দ্রীয় সদস্য ও সংরক্ষিত নারী এমপি অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, বটিয়াঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খান, আওয়ামী লীগ নেতা বিনয় কৃষ্ণ রায়, নান্টু রায়, শ্রীমান্ত অধিকারী রাহুল, সনত কুমার বিশ্বাস, সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায় ও চালনা পৌর মেয়র অচিন্ত্য কুমার মন্ডল মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তবে এই আসনে বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ সোহেল দলীয় মনোনয়ন পেলে অবাক হবেন না দলীয় নেতা-কর্মীরা।
বিএনপি নির্বাচনে গেলে এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন আমীর এজাজ খান, জিয়াউর রহমান জিয়া, এস এম শামিম কবির, তৈয়েবুর রহমান, পার্থদেব মন্ডল। এছাড়া আসনটিতে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। ২০১৮ সালেও তিনি নির্বাচন করেছিলেন। আর সিপিবির বটিয়াঘাটা উপজেলা সভাপতি অশোক কুমার সরকার এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা সহসভাপতি মাওলানা আবু সাঈদ এবারও প্রার্থী হতে পারেন।
খুলনা-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও পুনরায় মনোনয়ন প্রত্যাশী পঞ্চানন বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে এবারও আমি শতভাগ আশাবাদী।’
আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী ননী গোপাল মণ্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০০৮ সালে আমি এমপি হওয়ার পর অবহেলিত এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছি। আগামীতে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে দাকোপ-বটিয়াঘাটায় কৃষি ও যোগাযোগে বিপ্লব ঘটাতে চাই। আমি আশা করি দল এবার আমাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেবে।’
এদিকে, খুলনা বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ‘নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। দলের হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেবেন সবাই তাই মানবে।’
উল্লেখ্য, খুলনা-১ আসনে মোট ভোটার ২ লাখ ৯০ হাজার ২৬৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৬৭ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৮ জন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন ননী গোপাল মন্ডল। তিনি ওই সময় পান ১ লাখ ২০ হাজার ৮০১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আমীর এজাজ খান পান ৬৮ হাজার ৪২০ ভোট। তবে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের টিকিট পান সাবেক এমপি পঞ্চানন বিশ্বাস। কিন্তু ননী গোপাল দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনে ননী পঞ্চানন বিশ্বাস ৬৬ হাজার ৯০৪ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। আর ননী গোপাল পান ৩৪ হাজার ৫৩৭ ভোট। এর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান পঞ্চানন বিশ্বাস। ওই নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আমীর এজাজ খান পান ২৮ হাজার ৪৩৭ ভোট।
সারাবাংলা/আরআইটি/পিটিএম
আমীর এজাজ খান খুলনা-১ আসন জিয়াউর রহমান জিয়া তৈয়েবুর রহমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ননী গোপাল মণ্ডল পঞ্চানন বিশ্বাস পার্থদেব মন্ডল সুনীল শুভ রায়