আ.লীগে একক প্রার্থী শেখ জুয়েল, বিএনপি ফেরাতে পারে মঞ্জুকে
২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৯
খুলনা: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ‘সুন্দরবন’ তার একাংশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে যে জেলাটিকে সেটি খুলনা। সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের মতো অসংখ্যা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি এই খুলনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেন, বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাতসহ অসংখ্য গুণীব্যক্তির পূণ্যভূমিও এটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, খলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আবদুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য রাজনীতিক এই খুলনায় জন্ম নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত খুলনার রাজনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্তও সেই চাঙ্গাভাবের রেষ থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি ঝিমিয়ে পড়ে। মাঝে একবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছিল খুলনার রাজনীতি। তবে গোটা খুলনায় এখন রাজনীতির কোনো চমক নেই, জৌলুসও নেই। মাঝখানে তো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে রাজনীতি ফের চাঙ্গা হয়েছে।
আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা এখনও হরতাল-অবরোধ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই খুলনার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে খুলনা-২ আসনের চিত্র।
খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা থানা নিয়ে গঠিত খুলনা-২ আসনটি। এটি দেশের ১০০তম সংসদীয় আসন। আসনটি ধরে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপি নির্বাচনে গেলে আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। এই আসন ঘিরেই আবর্তিত হয় খুলনা জেলাসহ বিভাগের রাজনীতি। আন্দোলন, সংগ্রাম থেকে শুরু করে জেলা ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোও এ সংসদীয় এলাকায়। যে কারণে আসনটিকে নিজেদের দখলে নিতে চাই অন্য দলগুলো।
মুক্তিযুদ্ধের পর এই আসনটিতে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শেখ আবদুর রহমান, ১৯৭৯ সালে বিএনপির আবু সালেহ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মোহম্মদ মোহসিন ও ১৯৮৮ সালে মিয়া মুসা হোসেন। ১৯৯৬ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী এ আসন থেকে বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তার ছেড়ে দেওয়া আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা আলী আসগার লবী। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সে সময়কার নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু নির্বাচন হয়েছিলেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বয়কট করলে ১৯৭৩ সালের পর আসনটি ফিরে পায় আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ দলীয় জোট সমন্বয়ক মিজানুর রহমান মিজান নির্বাচন হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল।
এই আসনটিতে এখন পর্যন্ত দলের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র ও বর্তমান সংসদ সদস্য শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল। বিএনপি নির্বাচনে গেলে এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক এমপি আলী আজগর লবী, নগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা, শাহারুজ্জামান মর্তুজা, শফিকুল আলম তুহিন। অপরদিকে, এ আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে আছেন সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। অবশ্য এ হেভিওয়েট নেতা এখন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তাকেই এ আসনে প্রার্থী করা হতে পারে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
এছাড়াও জাতীয় পার্টির মহানগর নেতা অ্যাডভোকেট মহানন্দ সরকার ও অ্যাডভোকেট অচিন্ত কুমার দাস মনোনয়ন চাইতে পারেন। আর সিপিবি থেকে নাম শোনা যাচ্ছে দলের খুলনা মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি শ্রমিক নেতা এইচএম শাহাদাতের। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আউয়াল এবং জাকের পার্টি ও অন্যান্য দল থেকেও প্রার্থী হতে পারেন।
খুলনা-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও পুনরায় মনোনয়ন প্রত্যাশী শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনি এলাকায় বিগত কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। যার সুফল পাচ্ছে জনগণ। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এবারও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে মনোনয়ন দেবেন বলে প্রত্যাশা।’
মনোনয়ন নিয়ে জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দাবি বাস্তবায়নের পরই বিএনপি নির্বাচন নিয়ে ভাববে। দল যখন নির্বাচনে যাবে, তখন অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারে। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের তৃণমূলের কর্মীরা মামলা, হয়রানি, নির্যাতন সহ্য করছেন। তবে মানুষ ভোটের অধিকার ফিরে পেলে খুলনায় ফের বিএনপিকে ভোট দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
উল্লেখ্য, খুলনা-২ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২০ হাজার ২১৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৪৯ জন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচিত হন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিনি ওই সময় পান ৯০ হাজার ৯৫০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান পান ৮৯ হাজার ২৮০ ভোট। তবে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের টিকিটে জয় পান মিজানুর রহমান। তিনি পান ৬৯ হাজার ১৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টি-জেপি’র রাশিদা করিম বাইসাইকেল প্রতীকে পান ৩ হাজার ৬৪৯ ভোট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। তিনি ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু পান ২৭ হাজার ৩৭৯ ভোট।
সারাবাংলা/আরআইটি/পিটিএম
আলী আজগর লবী খুলনা-২ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নজরুল ইসলাম মঞ্জু শফিকুল আলম মনা শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল