তাজরীন অগ্নিকাণ্ড: ১১ বছরও শেষ হয়নি বিচার, ঝুলছে সাক্ষ্যগ্রহণে
২৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:২৪
ঢাকা: রাজধানীর অদূরে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আজ ১১ বছর। সেই অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ১১৩ জন শ্রমিক। ভয়াবহ ওই ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম মামলা দায়ের করলেও ১১ বছরেও শেষ হয়নি বিচারকাজ। এখনো শেষ হয়নি মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ। সাক্ষীরা আদালতে ঠিকমত না আসার কারণে মামলার কার্যক্রম শেষ হতে দেরি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শফিকুল ইসলামের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত আগামী বছরের ২৫ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেন। আদালত ৬ জন সাক্ষীর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এখন পর্যন্ত মামলাটিতে ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। বাকি এখনও ৯৩ জন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৮ মে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসের দুই কর্মী সাক্ষ্য দেন। বিগত দেড় বছরে আর কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো.মুর্শিদ উদ্দিন খাঁন জানান, রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট তৎপর মামলাটির বিচার শেষ করতে। কিন্তু সাক্ষী না আসায় মামলাটির বিচার শেষ হচ্ছে না। সাক্ষীদের সমন পাঠানো হয়, ফোন দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। তারপরও তারা আসেন না। আদালত মামলাটি শেষ করতে জোর দিচ্ছেন। কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার পর সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ করা হবে। আশা করি খুব দ্রুতই মামলাটির নিষ্পত্তি হবে। ভিকটিম তার ন্যায় বিচার পাবেন।
আসামিদের পক্ষের আইনজীবী হেলেনা পারভীন জানান, মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ ঠিকমত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছেন না। এজন্য সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ হচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাক্ষীরা অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক। মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে তাদের ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরাও চাই মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি চলমান থাকায় আসামিরাও মানসিক ও আর্থিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হলে আসামিরা ন্যায় বিচার পাবে।
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী রোকেয়া বেগম বলেন, মামলাটি দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। সব সাক্ষীদের বার বার প্রসেস পাঠানোর পরেও সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। সত্য কথা হচ্ছে, ঘটনাস্থলে আসামিরাও ভিকটিমাইজ ছিল। কে বা কারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে আদালতে সাক্ষীর মাধ্যমে ওইভাবে প্রমাণিত হয়নি। এখন পর্যন্ত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও লাশ সনাক্তকারী ছিলেন কারোই সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। সাক্ষী যেহেতু বিলম্ব হচ্ছে, এজন্য সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধের জন্য আমরা আবেদনও করেছি। কিন্তু আদালত আরও একবার সময় দিয়েছেন সাক্ষীদের উপস্থিত করার জন্য। এই পর্যন্ত ১১ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। এদের মধ্যে কেউই আসামিদের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। কোনো সাক্ষী প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি যে, আসামিরা ওইখানে ছিলেন বা আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে। আসলেই আমরাও ওখানে ভিকটিমাইজ হয়েছি। এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। দুর্ঘটনার কারণে আগুনটা লেগেছিল বলে সব সাক্ষীরাই মন্তব্য করেছেন।
২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের পর ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক এ কে এম মহসীনুজ্জামান।
মামলার অভিযুক্ত আসামিরা হলেন, প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রতিষ্ঠানটির লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও শহীদুজ্জামান দুলাল। তবে এই মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে আল আমিন, রানা, শামীম, ও মোবারক হোসেন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তাজরীন গার্মেন্টস ভবনের নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া বলে শ্রমিকদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়।
২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ আদালত।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১৩ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়। আহত হন আরও ১০৪ গার্মেন্টস শ্রমিক। গার্মেন্টসটিতে সে সময় ১ হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহত ১১১ জনের মধ্যে তৃতীয় তলায় ৬৯ জন, চতুর্থ তলায় ২১ জন, পঞ্চম তলায় ১০ জন, পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান ১১ জন। ৫৮ জনের লাশ শনাক্ত হওয়ায় তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৫৩ জনের লাশ শনাক্ত না হলে তাদের জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সারাবাংলা/এআই/আইই