Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আসন সমঝোতার কৌশলে স্বতন্ত্রে ‘লাগাম’ আ.লীগের

নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৮ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:০৯

ঢাকা: একতরফা নির্বাচনে জয়লাভের তকমা এড়াতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভোটের মাঠে তাই উৎসবমুখর পরিবেশের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাও প্রত্যাশা দলটির। সে কারণেই দলের মনোনয়ন না পাওয়া বিপুল পরিমাণ নেতাকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল এই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য। বলা হয়েছিল, দলের ঘোষণা করা ২৯৮ প্রার্থীর কেউ যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় না পায়।

বিজ্ঞাপন

এর বাইরে নিজেদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের দিকেও নজর রাখতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। আগের মতো জোট বা মহাজোটের অংশ না হলেও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গেও ক্ষমতাসী দলটির ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে। আগের তিনটি নির্বাচনেই এসব দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কৌশল বাস্তবায়ন করেছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচনমুখী দলগুলোও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে আওয়ামী লীগের কাছে। দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে জোট শরিক, মিত্র ও নির্বাচনমুখী দলগুলোর স্থানীয় জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এবারও আসন সমঝোতার কৌশল নিতে পারে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে দলের মনোনয়নের তালিকায় যারা রয়েছেন, পুড়তে পারে তাদের অনেকের কপাল। আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে সবাইকে উৎসাহ দেওয়া হলেও ভোটের সমঝোতার কৌশলে সেই উৎসাহেও লাগাম টেনে ধরা হতে পারে।

দলটির শীর্ষ নেতারা জানান, দলের মনোনয়ন পেলেই নৌকার সংসদ সদস্য নিশ্চিত— এমন ধারণার অবসান ঘটাতেই দলের মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় খোদ উৎসাহিত করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা। মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের দিন (২৬ নভেম্বর) দুপুরে গণভবনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এই রকম বার্তা দেন। এ বার্তার পর থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত সংসদ সদস্য ও নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে মনোনয়ন ফরম জমা দেন।

সেদিন গণভবনে উপস্থিত মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘হয়তো কোনোটা খুব সঠিক হবে, কোনোটা খুব বেঠিক হবে। যাই হোক, আমরা মনোনীত করতে পেরেছি। আপনারা চিন্তা করতে পারেন তিন হাজার ৩৬৯ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীর নাম জমা পড়ার বিষয়টি! আপনাদের সমস্ত ফাইলগুলো দেখা সেখান থেকে প্রার্থী বের কত বড় একটা কঠিন কাজ! সেটি করতে হয়েছে আমাদের। তিন শ নামের মধ্যে দুটি আসন আমাদের ফাঁকা আছে। শরিকদের জন্য রাখা আছে। বাকি এবার সব নামগুলো দিচ্ছি। এই কারণে ঠিক আছে যে আমাদের সঙ্গে যদি জোটে আসে, সেটা আমরা বিবেচনা করব। তবে আমরা চাই, এই ১৫ বছর ধরে জোটের এদের লালন-পালন করেছি, তারা নিজেরাও একটু হাঁটতে শিখুক, চলতে শিখুক, পড়তে শিখুক।’

বিজ্ঞাপন

পাশাপাশি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে প্রার্থীরা যেন বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে আসতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখার নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। আর মনোনয়নবঞ্চিত হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করার উৎসাহ দেন। আর নৌকার কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আসার কৌশল নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করার উৎসাহের পর থেকে সারাদেশে মনোনয়নবঞ্চিত নেতা ও বাদপড়া কিছু সংসদ সদস্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দেন। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নৌকা মার্কার অগণিত প্রার্থী। দল থেকে নৌকা পেলেই এমপি, তাদের এই আত্মবিশ্বাসের ধাক্কা লেগেছে।

তবে দলটির তৃণমূল নেতারা, স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় উৎসাহ প্রদান দলের নির্বাচন বৈতরণী পার করার কৌশল কিনা তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন। এ বিষয়ে এমন আভাসই দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ওবায়দুল কাদের। সারাদেশে যেভাবে ফ্রি স্টাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দলের মনোনয়নবঞ্চিতরা প্রার্থীর ঘোষণা দিয়েছেন তাতে এরই মধ্যেই দুশ্চিন্তার কারণ উঠছে বলে মনে করে দলটির হাইকমান্ড। তাই আসন সমঝোতার আলোকে আসনওয়ারী স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হবে।

মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সমসাময়িক এক ব্রিফিংয়ে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ফ্রি-স্টাইল হবে না। আমরা দেখি কারা কারা চাইছেন। সেটার ওপর আমাদের একটা সিদ্ধান্ত আছে। আমাদের কৌশলগত একটি সিদ্ধান্ত আছে। কাজেই এর মধ্যে আমরা এখানে পরিবর্তন পরিবর্ধন সংযোজন সংশোধন অ্যাকোমোডেশন সবকিছু আমরা করতে পারি।

আসনভিত্তিক একেক একেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল থাকবে কিনা— এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলের কৌশল তো থাকবেই। আমরা ইলেকশন করছি। আমরা একটা রাজনৈতিক দল। আমাদের কৌশলগত দিক তো থাকবেই।’

১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাদের সঙ্গে অ্যালায়েন্স আছে। নির্বাচন জোটবদ্ধ হবে। তারা কারা কারা প্রার্থী সেটি আমরা দেখি। আমাদের হাতে কিছু সময় আছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে আমরা অবজার্ভ করব, মনিটর করব, অ্যাডজাস্টমেন্ট করব, অ্যাকোমোডেটেড করব। সেখানে যেটি প্রয়োজন সেটি আমরা করব। স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়টাও ওইরকম। ডামি ক্যান্ডিডেটের বিষয়েও ব্যাপারটা এরকম। ১৭ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে সবকিছু ফাইনালিস্ট হয়ে যাবে।’

দলীয় সূত্র জানায়, এবার ১৪ দলীয় জোট ও মিত্র জাতীয় পার্টিকে আগের তুলনায় কম আসনে সন্তুষ্ট রাখতে কৌশলী চাপ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে নির্বাচনি মিত্র জাতীয় পার্টি ১৫ থেকে ২০ টি, কেন্দ্রীয় জোট শরিক দলগুলোর নেতাদের ৪ থেকে ৫টি আসন ছাড় দিতে পারে। আবার নির্বাচনমুখী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জেটাগুলোর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ আসন সমঝোতোর ভিত্তিতে আসনওয়ারী কৌশলী হবে দলটি। কারণ দলটি এরইমধ্যে ২৯৮ আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এখনও ১৪-দলীয় জোট ও মিত্রদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। ফলে শরিকেরা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পাবে কি না বা আসন সমঝোতা কী হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে।

আওয়ামী লীগ সূত্রের দাবি, জোট শরিক ও মিত্ররা কে কোথায় মনোনয়নপত্র দাখিল করছে, সেটি দেখে তারপর আসন সমঝোতা হবে। তাই আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম জমা শেষ দিনের পর আসন সমঝোতার বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে বলে মনে করছেন তারা। এবারও দলীয় প্রার্থিতার পাশাপাশি জোটবদ্ধ নির্বাচন করার কথা জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র মতে, এবার জোট, নির্বাচনি মিত্র ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে ৫০-৬০টি আসনের সমঝোতা হতে পারে। যদি জোট শরিকদের চাওয়া অনেক বেশি। তবে টানা ১৫ বছরে কেন্দ্রীয় জোট শরিক ও জাতীয় পার্টির চাওয়া-পাওয়াকে এবার ততটা পাত্তা দিচ্ছে না দলটির হাইকমান্ড। কারণ ক্ষমতার সুবাতাসে সারাদেশে এসব দল ও নেতাদের গ্রহণযোগ্যতার পাল্লা ভারী হয়নি। তাই এবার নির্বাচনমুখী নতুন দলগুলোর দিকে মনোনয়ন যোগ্য নেতাদের দিকে নজর আছে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও দলত্যাগী অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিকে নজর রাখছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে কোনো কোনো আসনে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে কাউকে দেয়নি আওয়ামী লীগ।

এদিকে নির্বাচনি মিত্র জাতীয় পার্টি এরইমধ্যে ২৮৭ আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

এর আগে গত ২০ জুলাই ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপর আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি।

এদিকে এবার এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৬টি দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে জাপা, ১৪ দলের শরিক, ইসলামপন্থী কয়েকটি দল, কিংস পার্টিসহ বাকিরাও আসন সমঝোতার কৌশলে ভোটের মাঠে রয়েছে। জাপা বাদে জোটসঙ্গীরা বেশির ভাগ নৌকা প্রতীকে ভোট করতে চায়। একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট এবং মহাজোটের বিকল্প ধারা ও জাতীয় পার্টিকে মোট ৩১টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরসহ ২৩ জন, রাশেদ খান মেননসহ ওয়ার্কার্স পার্টির তিনজন, হাসানুল হক ইনুসহ জাসদের তিনজন, মাহি বি চৌধুরীসহ বিকল্পধারার দুজন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এবং জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সংসদ সদস্য হন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তিন শ আসনেই জয়লাভ করবে— এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে। নির্বাচনে যে কেউ প্রার্থী হতে পারে। যে কেউ নির্বাচনে করলে কেউ হারলে সেটি মেনে নিতে হবে। নির্বাচন শতভাগ ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার হবে। সেখানে জয়-পরাজয় প্রার্থীর ওপর নির্ভর করবে। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। কারা কীভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেটির জন্য আমাদের আপাতত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আসন সমঝোতার বিষয়ে বলা যাবে।’

সারাবাংলা/এনআর/একে

আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি জাপা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর