‘বাবার ছেলে’ রুহেলের সঙ্গে লড়াইয়ে ‘মাঠের নেতা’ গিয়াস
২৯ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব রহমান রুহেল। বর্ষীয়ান নেতার উত্তরসূরী হিসেবে সহজে মনোনয়ন আদায় করে নিতে পারলেও ভোটের মাঠে তিনি ছাড় পাচ্ছেন না। তাকে মোকাবেলা করতে হবে মীরসরাইয়ের আরেক আলোচিত নেতা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন।
‘মাঠের নেতা’ হিসেবে পরিচিত মীরসরাইয়ের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন। বুধবার (২৯ নভেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন। গিয়াস একা নন, মীরসরাইয়ের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী, হাল আমলে প্রভাব তৈরি করা কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা নিয়াজ মোর্শেদ এলিটও তার পাশে আছেন।
সভায় গিয়াস বলেছেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন হেভিওয়েট নেতা, কিন্তু উনার সন্তান হেভিওয়েট নন। আমি আজ ৫০-৫২ বছর ধরে রাজনীতি করি, আমি নিজেকে হেভিওয়েট মনে করি না। আমি নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন মাঠের কর্মী মনে করি।’
১৯৭০ সাল থেকে চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডেরও একজন। সাতবার সংসদ সদস্য এবং দু’বার মন্ত্রী ছিলেন। ৮২ বছর বয়সী মোশাররফ সরে গিয়ে এবার নির্বাচনের মাঠ তুলে দিয়েছেন ছেলে রুহেলের হাতে। উচ্চশিক্ষিত রুহেল চলচ্চিত্র প্রযোজনা, সিনেপ্লেক্স ও হোটেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
অন্যদিকে মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন আশির দশকের ছাত্রলীগ নেতা। পরবর্তীতে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগেও সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৯ সালে তিনি মীরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। একসময় মোশাররফ ও গিয়াসের মধ্যে ‘গুরু-শিষ্যের’ সম্পর্ক থাকলেও ২০০৯ সালের পর তাতে ভাঙন ধরে। দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন, মোশাররফ ভবিষ্যতের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে গিয়াসকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
মোশাররফের সঙ্গে দূরত্বের পর গিয়াসকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আর মনোনয়ন দেয়া হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোশাররফের প্রার্থী শেখ আতাউর রহমানের কাছে হারেন।
এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন গিয়াস। কিন্তু দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র প্রার্থীতা উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা দিলে মাঠে নামেন গিয়াস।
দুপুরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রার্থীতা ঘোষণা করে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘মীরসরাই থেকে যিনি বারবার নির্বাচিত হয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, তিনি দেড় বছর আগে ঘোষণা দিয়েছেন এবার তিনি নির্বাচন করবেন না। তখন মীরসরাইবাসী আশায় বুক বেঁধেছিলেন, এবার বোধহয় আমাদের গিয়াস মনোনয়ন পাবে। কিন্তু উনার ছেলেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।’
‘এর মধ্যে আমাদের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীতার বিষয়টি ঘোষণা করেছেন। তখন থেকে মীরসরাইয়ের জনগণ আমাকে বারবার চাপ দিচ্ছেন। শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি নির্বাচন করবো। আমি আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) মনোনয়নপত্র দাখিল করব।’
নিজের রাজনৈতিক জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনেকের মনে প্রশ্ন, আমি কেন নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হলাম ? আমার রাজনীতির বয়স ৫০ থেকে ৫২ বছর। ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে আজ আমি এ অবস্থায় এসেছি। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে।’
‘খালেদা জিয়ার অপারেশন ক্নিনহার্টের সময় প্রথম রাতে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমার ভাইয়ের লাশ নিয়ে আমি বাড়িতে যাই। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমি ভাইয়ের জানাজা না পড়ে পালিয়ে যায়। এরপর আমি নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে আমি প্রতিদিন সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আমার এলাকার রোগীদের খোঁজখবর নিই, তাদের পাশে দাঁড়াই। মীরসরাইয়ের আবু তোরাবে যখন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন স্কুলছাত্র মারা গেল, আমি নিজে তাদের দাফন-কাফন সম্পন্ন করেছি। আমি প্রমাণ করেছি, ক্ষমতা না থাকলেও ইচ্ছা থাকলে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। বিএনপি-জামাতের অগ্নিসন্ত্রাসের সময় আমি দুইমাস মীরসরাইয়ে থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করেছি। অথচ আমাদের পাশের উপজেলা সীতাকুণ্ডকে অগ্নিসন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছিল।’
নির্বাচিত হলে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত মীরসরাই গড়ার ঘোষণা দিয়ে গিয়াস বলেন, ‘সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ থাকলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মীরসরাইয়ে শিল্পনগর করেছেন, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। মীরসরাইকে পর্যটনবান্ধব উপজেলা হিসেবে আমি গড়ে তুলব।’
মীরসরাইয়ে গেলে কোনো ধরনের হামলার আশঙ্কা করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকবার আমার ওপর হামলা হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। কিছুদিন আগেও আমার গাড়িতে হামলা হয়েছে। তবে আমি গায়ের জোরে কিছু করতে রাজি নয়। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে চাই। ইনশল্লাহ আমি এলাকায় যাব, জন্মেছি যখন মরবো একদিন। নির্বাচনে যখন দাঁড়িয়েছি, সামনে যাব, পেছনে যাবার সুযোগ নেই।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ফেভার চাই না, শুধু মীরসরাইবাসী যাতে সুষ্ঠুভাবে তাদের ভোটটা দিতে পারে সেটা চাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচনের কাজে যারা নিয়োজিত আছেন, তারা যেন এটা তত্ত্বাবধান করেন। যারা দেশিয় ও আন্তজার্তিকভাবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন, সেটা যাতে তারা করতে না পারেন আর র্যাব, পুলিশ-বিজিবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সোচ্চার থাকলে ইনশল্লাহ পারবে না।’
সভায় গিয়াস উদ্দিনের পাশে কেন্দ্রীয় যুবলীগ সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট ছাড়াও মীরসরাইয়ের আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা, জাহেদ ইকবাল চৌধুরী, রবিউল হোসেন রবি এবং নিজাম উদ্দিন ছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এনইউ