ক্ষুদে লেখকবন্ধু রাইদাহ গালিবাকে ভুলব না কখনো
৩০ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫৫
‘সন্তান হারানোর জ্বালা, তোমরা কি করে বুঝবে?/ তোমাদের কি পায়ের তলার মাটি সরে গেছে?/ যে চোখ দুটো দিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখ,/ সে দুটো তো এখনও অন্ধ হয়ে যায়নি,/ তিল তিল করে যেগুলো সঞ্চয় করেছ,/ সেগুলো তো কর্পূরের মতো এখনও উবে যায়নি,/ তোমাদের ঘরের ছাদ, দেওয়াল, এগুলো/ এখনও তো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েনি।’ সন্তান হারানোর এই জ্বালা বুঝেছিলেন কবি সুবীর ভট্টাচার্য্য। আর এখন হৃদয় দিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন কথাসাহিত্যি ও কবি কানিজ পারিজাত! মাত্র ১২ বছরের বিরলপ্রজ ও ক্ষণজন্মা রাইদাহ গালিবাকে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন চিকিৎসকের চরম অবহেলায়।
মৃত্যু অমোঘ সত্য, কিন্তু অবহেলায় মৃত্যু কীভাবে মেনে নেবেন মা; যদি স্পষ্টত সন্তানটির ভেতরে দেখতে পান অমিত সম্ভাবনার শক্তি? যার অবহেলায় প্রাণ দিতে হলো ছোট্ট শিশুটিকে, তার কি কঠিন শাস্তি হবে না?
রাইদাহর ডাক নাম ছিল কুইন। তারা ছিল দুই ভাই-বোন। রাইদাহ ছিল বড়। কুইন রাজরানী হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল। জন্মেই সে ঘর আলোকিত করেছিল। এক-দুই করে তার বয়স যত বাড়তে থাকে, তেমনি বড় হতে থাকে শারীরিক কাঠামোয়। দুই-তিন বছরের শিশুর দৈহিক গড়নে যতটুকু বড় হওয়ার কথা, রাইদাহ বাড়তে থাকে তার দ্বিগুণ হয়ে। দৈহিক গড়নের সঙ্গে বড় হতে থাকে তার ছোট্ট মনটিও। দৈহিক গড়ন আর বাড়ন্ত মনের রসায়নের খবরটি কেবল একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কানিজ পারিজাত, রাইদাহর মা। কন্যাকে নিয়ে তাই তার মনে তৈরি হয়েছিল বিপুল আশা। রাইদাহ মায়ের বেঁচে থাকার প্রাণসঞ্চারি হয়ে উঠছিল। ভবিষ্যতের নির্ভরযোগ্য অবলম্বনও ভাবতে শুরু করেছিলেন মা কানিজ পারিজাত।
ছোট্ট রাইদাহ মুখে মুখে গল্প বলত। তার মুখে সৃষ্টি করা গল্প সে সবাইকে শুনিয়ে বেড়াতে লাগলো, কিছুদিন পার হওয়ার পর মা খেয়াল করলেন রাইদাহর মুখে বলা গল্পগুলো আসলে পরিপূর্ণ রূপকথার গল্প হয়ে উঠেছে। এভাবেই মেয়ের মধ্যে গল্পকারসত্ত্বা খুঁজে পান কানিজ পারিজাত। অত্তটুকুন রাইদাহ গণিত, বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ও ভালোবাসতে শুরু করেছিল। তার জানার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। দ্রুত আত্মস্থ করতে পারত। মুখস্থবিদ্যা তার ছিল একদম অপছন্দ। যা পড়ত, বুঝেশুনে পড়ত। ফলে মুখস্থের প্রয়োজন হতো না। রাইদাহ প্রকৃতিকে ভালোবাসত। ক্ষুদ্র প্রাণীর মৃত্যুও সে সহ্য করতে পারত না। অথচ প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস! তার ছোট্ট প্রাণটাই খেলো হয়ে গেল? মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে নেওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল ছোট্ট মেয়েটির। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নিজের শ্রেণির পড়া শেষ করে ওপর ক্লাসের বইপাঠ নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অন্য শিশুদের থেকে সে ছিল অগ্রসর; যেমন পঠনপাঠে, তেমনি সৃজনে ও মননে। যেমন ছিল শান্ত, তেমনি ধীরস্থির।
এত্তটুকুন বয়সেই দেশের নামকরা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় রাইদাহ গালিবার অনেকগুলো গল্প ও ছড়া-কবিতা। ছয় বছর বয়সে তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমির শিশু-কিশোরদের জন্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশ’-এ। গল্পটির নাম ‘বাঘ ও দৈত্য’। একাধিক গল্প প্রকাশ পায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকায়। পরে প্রতিটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় আলাদা আলাদা গল্পবই। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো হলো- ‘পিটুর জাদু জুতা’, ‘এক যে ছিল মুচি’, ‘ইমা ও দৈত্য’। রাইদাহর চতুর্থ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের কথা ছিল ২০২৩ সালের বইমেলায়। ধুন্ধমার প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু তার আগেই অকালে ঝরে গেল এই তরতাজা প্রাণ! আর নেওয়া হলো না তার নতুন বইয়ের ঘ্রাণ!
রাইদাহ পড়ত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে, পঞ্চম শ্রেণিতে। ২০২২ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। হঠাৎ জ্বর এলো রাইদাহর। শুরুতেই ডাক্তার দেখিয়ে রক্তের পরীক্ষাও করা হলো, জানা গেল ডেঙ্গুজ্বর! দেরি না করে সাথে সাথেই তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো দেশের নামিদামি বিশেষায়িত এক বেসরকারি হাসপাতালে, বিশেষজ্ঞ (!) এক চিকিৎসকের অধীনে। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ (!) চিকিৎসক ও তার অধীনস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সুস্পষ্ট অবহেলায় ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে রাইদাহ চলে গেল না ফেরার দেশে! আর এর মধ্য দিয়ে নীরবে হারিয়ে গেল উজ্জ্বল প্রতিভার এই মেধাবী শিশুটি। মিশিয়ে/মিলিয়ে গেল দূর আকাশের লাখো তারার মাঝে।
সৃষ্টিকর্তাকে বলি, ক্ষুদে এই শিশুসাহিত্যিক বন্ধুটির আত্মা শান্তিতে রেখো। হে প্রভু, রাইদাহকে যেখানেই রাখো, ভালো রেখো, আনন্দে রেখো। আর রাইদাহর মতো বিরলপ্রজ প্রতিভা যার চরম অবহেলায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিল, তাকেও কঠিন শাস্তি দিও।
সারাবাংলা/পিটিএম