Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছোট কম্পন বড় ভূমিকম্পের আভাস, এরপর ‘৭ মাত্রা’

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:৫৯

ঢাকা: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকালে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬। ভূতত্ত্ববিদদরা বলছেন, এমন ছোট মাত্রার ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বহন করে। আগামী ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ঝুঁকিতে দেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল। কারণ এই অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে ৯ টা ৩৫ মিনিটে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ এলাকায়।

সকাল ৯ টা ৩৫ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ সময় অনেকেই ঘর ছেড়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসেন। কিছু কিছু স্থানে বড় বড় ভবনে ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ঘরের ছাদ ফেটেছে। কোথাও মেঝের টাইলসে ফাটল দেখা গেছে। কুমিল্লায় ছোটাছুটিতে পদদলিত হয়ে অর্ধশত আহতের খবর জানা গেছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক সারাবাংলাকে জানান, ভূমিকম্পের সময় তিনি নিজেই মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে পরিবারকে নিয়ে খোলা জায়গায় বের হয়ে আসেন।

তিনি জানান, রামগঞ্জের ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব-উত্তরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল। আর এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। তিনি বলেন, ‘এটি এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার কোনো পূর্বাভাস আগে থেকে পাওয়া যায় না।’

এদিকে এই ভূমিকম্পকে ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন ভূতত্ববিদদরা । তারা বলছেন, বড় ভূমিকম্পের আগে এমন ছোট ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তুরস্ক ও নেপালের উদাহরণ টানেন।

এ প্রসঙ্গে ভূতত্ববিদ অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বহুদিন থেকে বলে আসছি ভবিষ্যতে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা যারা ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করি আমরা বলি বড় ভূমিকম্প আসার আগে এমন ছোট কম্পন হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে ঘন ঘন ভূমিকম্পের ইতিহাস অনুযায়ী আমাদের ধরে নিতে হবে সামনে একটি বড় ভূমিকম্প আসছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া মানে বড় হওয়ার ইন্ডিকেশন। তুরস্কে ভূমিকম্প হওয়ার আগে এমন ছোট মাত্রার শতাধিক ভূমিকম্প হয়েছে। আমাদের যে সাত মাত্রার ভূমিকম্প আসবে সেটি ধরে নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া নয়, সরকারকে এখনি উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে তুরস্ক নেপালের চেয়েও বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’

বাংলাদেশে ঝুঁকির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘দেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকায় গত কয়েক বছরের মধ্যে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের উৎপত্তিস্থলই ছিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে। অনেকগুলো ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের মিজোরাম বা ত্রিপুরা রাজ্যে। তবে ঢাকার আশেপাশে উৎপত্তিস্থল রয়েছে, এমন ভূমিকম্পও মাঝেমধ্যেই হতে দেখা গেছে।’

তিনি জানান, ১৮৬৯ সালে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয় বগুড়াতে। ১৮৮৫ সালে হয়েছে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আসাম সীমান্তে। এটির জন্য রাজধানীর আহসান মঞ্জিল, আর্মিটোলা চার্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে হয়। ১৯৩০ সালে কুচবিহারে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এসব ইতিহাস বলে দিচ্ছে ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্প আসছে। যেহেতু এটি দেড়শ বছরের একটি সার্কেলে হয়ে থাকে।’

আর্থকোয়েকট্র্যাক এর তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ২০০৮ এ টাঙ্গাইলের কাছে নাগরপুরে এবং ২০১৯ সালে মির্জাপুরে চার মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৫ বছরে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জে অন্তত চারবার ভূমিকম্প হয়েছে আর ঢাকার কাছে ফরিদপুরেও গত ১৫ বছরের মধ্যে দুইবার চার মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে বলে সংস্থাটির তথ্যে রয়েছে। এসব তথ্যের ওপরে ভিত্তি করেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প সন্নিকটে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান প্রতিমন্ত্রি ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা আগে থেকে জানার সুযোগ নেই। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আমরা পূর্বাভাস পাই যে কারণে আমরা মানুষকে সর্তক করতে পারি। এখানে রাজউক মজবুত করে ঘরবাড়ি নির্মাণে পরামর্শ দিতে, তদারকি করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘উদ্ধার কাজের জন্য সিটি করপোরেশনগুলোকে আলাদা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এ সব অঞ্চলে ৩৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধার কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। নগদ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া আছে।’

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী আরো বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতির সময় এসে গেছে। যদিও ২০ বছর আগেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। রাজধানী ঢাকার ভবনগুলো পরীক্ষা করা উচিত। ২০১৬ সালে রাজউক একটি কমিটি করেছিল। আমি সেই কমিটিতে থেকে সুপারিশ করেছিলাম ভবন চেক করার জন্য। কিন্তু রাজউক তা করেনি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গুরুত্বের অভাবে কাজটি হয়নি। যখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তখন কিন্তু দায় কেউ এড়াতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘তুরস্কে ভূমিকম্পে ৫০ হাজার লোক মারা যাওয়ার পরে সরকার আরেকটি কমিটি গঠন করে। আমরা জানি কী কী করতে হবে। আমরা বলেছিও। গত ৬ মাসে মাত্র একটি মিটিং করা সম্ভব হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘রাজউকের বড় ইচ্ছার অভাব। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ঢাকার অনেক ভবন থার্ড পার্টি দিয়ে চেক করিয়েছে। এটি রাজউক করতে পারে। এখানে কিন্তু অনেক খরচ খুব বেশি না। যারা কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনছেন তিনি আরেকটু টাকা খরচ করে সার্টিফিকেট নিতে পারছেন না। সার্টিফিকেট নেওয়ার বিষয়ে বাধ্য করতে হবে। রাজউক মাত্র ৬৮টি সার্টিফিকেট দিয়েছে এতদিনে। এদিকে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর রাজধানীর পোশাক কারখানাগুলো শৃঙ্খলায় ফিরেছে, এটি শুভ লক্ষণ।’

সারাবাংলা/জেআর/একে

বাংলাদেশ ভূমিকম্প সিলেট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর