৩ ডিসেম্বর ১৯৭১— যৌথ কমান্ডের আক্রমণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী
৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৪৫
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। যৌথ কমান্ডের সাঁড়াশি আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিজয়ের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যায় মুক্তিপাগল বাঙালিরা। এদিন ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। এদিন গভীর রাতে মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।
যৌথবাহিনী ঘোষণার পর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এতদিন নেপথ্য মুক্তিবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সমহযোগিতা দিয়ে আসছিল। এদিন থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়ে মিত্রবাহিনী।
এদিন কুমিল্লায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে মিয়াবাজার দখল করে নেন। এদিন মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর মাইজদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর দুর্বার আক্রমণ শুরু করে। আখাউড়া সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে চলে বিরতিহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সাতক্ষীরায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে পালিয়ে যায়। রংপুরের পলাশবাড়িতে পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনারা এবং সেখানে কিছু সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন যশোর ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর সাবমেরিন ‘গাজী’কে মিত্রবাহিনী বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে।
সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদার বাহিনী পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেড়ে পাকিস্তান বাহিনী দেশের বিভিন্নস্থানে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী যে অত্যাচার করেছে, শরণার্থীরা কেন ভারতে আসছে তার কারণ অনুসন্ধান কেউ করেনি, করতে চায়নি। বিদেশের কাছে বারবার সব বলা হয়েছে— কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এভাবে মরতে দিতে পারি না, আমরা মরতে দেব না, ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের পূর্ণ সাহায্য বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে থাকবে।’
এদিকে, সমাবেশ চলা অবস্থায় মঞ্চের মধ্যেই জরুরি খবরে আসে পাকিস্তান বিনা উসকানিতে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারত আক্রমণ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে রাজধানী নয়াদিল্লিতে চলে যান এবং ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় দিবাগত রাত ১২টা ২০মিনিটে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দেন এবং দেশব্যাপী ঐক্য ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য আহ্বান জানান এবং প্রতিটি নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির গভীর সংকট মোকাবিলার জন্য আহ্বান জানান। সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’
এই ঘোষণার পরপরই ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের-ভারত যৌথ কমান্ড। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় এদিন থেকেই। গভীর রাতে চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী- আর মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
এই দিন তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দেবে।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম