ড. ইউনূসের পক্ষে যাওয়া রায়ে স্থিতাবস্থা
৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:০৪
ঢাকা: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মীকে মুনাফার অংশ দিতে নির্দেশ দিয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় বাতিলের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছেন চেম্বার জজ আদালত। আদালত আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতিবস্থা জারি করে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওই দিন আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানি হবে।
রোববার (৩ ডিসেম্বর) আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার জজ আদালত এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন ও ব্যারিস্টার খাজা তানভীর আহমেদ। আর ১০৬ কর্মীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও আইনজীবী গোলাম রাব্বানী শরীফ।
আদেশের বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করে ব্যারিস্টার খাজা তানভীর আহমেদ বলেন, ‘শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিষয়বস্তুর (সাবজেক্ট ম্যাটার) ওপর স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) জারি করেছেন চেম্বার জজ আদালত। ফলে গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মীকে মুনাফার অংশ দিতে নির্দেশ দিয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে।’
মামলার মূল বিষয়বস্তু আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অমিমাংসিতই থাকছে বলে জানান ব্যারিস্টার তানভীর।
এর আগে, গত ৩০ নভেম্বর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় বাতিল করেন বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
ওইদিন আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, আবদুল্লাহ আল মামুন ও আইনজীবী খাজা তানভীর আহমেদ। অন্যদিকে, ১০৬ কর্মীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও আইনজীবী গোলাম রাব্বানী শরীফ।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, শ্রম আইনে গ্রামীণ কল্যাণের শ্রমিকেরা লাভের অংশ পাবে কি না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার এখতিয়ার কোনো শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের নেই।
পরে আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আজকের রায়ের পর গ্রামীণ কল্যাণকে তার সাবেক ১০৬ কর্মীদের কোনো লাভের টাকা দিতে হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম আইনের ২৩১ ধারা অনুসারে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে বা মতপার্থক্য হলে— এর ব্যাখ্যার জন্য সরাসরি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে। যেহেতু এ ক্ষেত্রে মালিক ও কর্মীর মধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি, তাই আপিল ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ নেই। আপিল ট্রাইব্যুনাল এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে রায় দিয়েছেন। আজ আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের ফলে গ্রামীণ কল্যাণকে তার সাবেক ১০৬ কর্মীদের কোনো লাভের টাকা দিতে হবে না।’
তিনি বলেন, ‘১০৬ জন সাবেক শ্রমিকের দাবি বেআইনি। কারণ, গ্রামীণ কল্যাণ নিছক একটি স্বাস্থ্যসেবামূলক দাতব্য সংস্থা। এটি কোনো শিল্প কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নয়।’ তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করার কথা জানিয়েছেন গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মীর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
এর আগে, গত ১০ জুলাই গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মীকে মুনাফার অংশ দিতে নির্দেশ দিয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় অবৈধ ঘোষণা প্রশ্নে জারি করা রুল দুই মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি এই সময়ে ১০৬ শ্রমিককে মুনাফা দিতে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের ওপর হাইকোর্টের দেওয়া স্থিতাবস্থা স্থগিতই থাকবে বলে আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
গ্রামীণ কল্যাণ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ কোম্পানিভুক্ত একটি অলাভজনক সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান।
শ্রম আইনে বলা আছে, ‘শ্রম আইন কার্যকর হওয়ার দিন থেকে কোম্পানির লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণ ও অংশগ্রহণ তহবিল দিতে হবে।’
২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ১০৬ জন শ্রমিক বিভিন্ন পদে গ্রামীণ কল্যাণে চাকরি করেছেন। তাদের কেউ অবসরে গেছেন। আবার কেউ চাকরিচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু চাকরির পর প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার কোনো অংশ তারা পাননি। অথচ ২০২১ সাল থেকে গ্রামীণ কল্যাণের মুনাফার অংশ শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে এই শ্রমিকরা মুনাফার অংশ চেয়ে প্রথমে গ্রামীণ কল্যাণের কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ দেন। সাড়া না পেয়ে পরে গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মী শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল থেকে মুনাফা (২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত) পেতে শ্রম আইনের ২৩১ ধারায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা (ব্যাখ্যামূলক) করেন। এর শুনানি নিয়ে গত ৩ এপ্রিল এ মামলার রায় দেন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ট্রাইব্যুনাল আইন-বিধি অনুসারে ২০০৬ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ের মুনাফার অংশ দিতে নির্দেশ দেন।
রায়ে গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মী ‘শ্রমিক কল্যাণ তহবিল’ ও ‘শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল’ থেকে মুনাফা পাওয়ার অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়। পরে ওই রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গ্রামীণ কল্যাণের পক্ষে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম মইন উদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্টে রিট (রিট পিটিশন নম্বর: ৫৬১৮/২০২৩) দায়ের করেন।
ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৩০ মে বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। একই সঙ্গে অন্তবর্তী আদেশে হিসেবে ট্রাইব্যুনালের রায়ের ওপর ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে শ্রমিকদের মুনাফার অংশ দিতে নির্দেশ দেওয়া শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয়। ফলে ১০৬ শ্রমিকের মুনাফা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া আটকে যায়। পরে ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করেন শ্রমিকেরা।
শুনানির পর হাইকোর্টের স্থিতাবস্থার আদেশ গত ২২ জুন স্থগিত করেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর চেম্বার আদালত। পাশাপাশি আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য গত ১০ জুলাই ধার্য করেন। পরে এর ধারাবাহিতকায় আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। গত ১০ জুলাই শুনানি শেষে দুই মাসের মধ্যে এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের প্রতি নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
এরপর শ্রমিকদের মুনাফার অংশ দিতে নির্দেশ দিয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় গত ৩০ নভেম্বর বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ১০৬ শ্রমিকের আপিলের শুনানি নিয়ে আজ (৩ ডিসেম্বর) মামলার বিষয়বস্তুর (সাবজেক্ট ম্যাটার) ওপর স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) জারি করেছেন চেম্বার জজ আদালত।
সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম