নির্বাচনে যাওয়া দলগুলোর ভোট ৫৬ শতাংশ, না যাওয়াদের ৩৭
৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:২৮
ঢাকা: নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সংসদে প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অন্যদিকে, রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ ১৬টি দল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাচ্ছে না।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলো হল— জাতীয় পার্টি (জেপি, নিবন্ধন নম্বর ২, প্রতীক বাইসাইকেল), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (নিবন্ধন নম্বর ৩, প্রতীক চাকা), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (নিবন্ধন নম্বর ৪, প্রতীক গামছা), বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (নিবন্ধন নম্বর ৬, প্রতীক নৌকা), গণতন্ত্রী পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ৮, প্রতীক কবুতর), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ৯, প্রতীক কুঁড়েঘর), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ১০, প্রতীক হাতুড়ি), বিকল্পধারা বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ১১, প্রতীক কুলা), জাতীয় পার্টি (জাপা, নিবন্ধন নম্বর ১২, প্রতীক লাঙ্গল), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ,নিবন্ধন নম্বর ১৩, প্রতীক মশাল), জাকের পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ১৬, প্রতীক গোলাপ ফুল), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন (নিবন্ধন নম্বর ১৯, প্রতীক ফুলের মালা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি, নিবন্ধন নম্বর ২২, প্রতীক আম)। গণফ্রন্ট (নিবন্ধন নম্বর ২৫, প্রতীক মাছ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ২৮, প্রতীক কাঁঠাল)।
এ ছাড়া ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ৩০, প্রতীক চেয়ার), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ৩১, প্রতীক হাতঘড়ি), ইসলামী ঐক্যজোট (নিবন্ধন নম্বর ৩২, প্রতীক মিনার), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (নিবন্ধন নম্বর ৩৫, প্রতীক মোমবাতি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (নিবন্ধন নম্বর ৪০, প্রতীক হাতের পাঞ্জা), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (নিবন্ধন নম্বর ৪১, প্রতীক ছড়ি), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ (নিবন্ধন নম্বর ৪২, প্রতীক টেলিভিশন), বাংলাদেশ কংগ্রেস (নিবন্ধন নম্বর ৪৪, প্রতীক ডাব), তৃণমূল বিএনপি (নিবন্ধন নম্বর ৪৫, প্রতীক সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম, নিবন্ধন নম্বর ৪৮, প্রতীক নোঙ্গর), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি, নিবন্ধন নম্বর ৪৯, প্রতীক একতারা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (নিবন্ধন নম্বর ২০, প্রতীক বটগাছ) এবং গণফোরাম (নিবন্ধন নম্বর ২৪, প্রতীক উদীয়মান সূর্য) নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
অন্যদিকে নির্বাচনে না যাওয়া দলগুলো হচ্ছে— লিবারেল ডেমোক্রেটি পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ১, প্রতীক ছাতা), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি (নিবন্ধন নম্বর ৫, প্রতীক কাস্তে), বিএনপি (নিবন্ধন নম্বর ৭, প্রতীক ধানের শীষ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি (নিবন্ধন নম্বর ১৫, প্রতীক তারা), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (নিবন্ধন নম্বর ১৭, প্রতীক মই), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ১৮, প্রতীক গরুর গাড়ি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ২৩, প্রতীক খেজুর গাছ)।
এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ৩৪, প্রতীক হাতপাখা), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ৩৭, প্রতীক কোদাল), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (নিবন্ধন নম্বর ৪৩, প্রতীক সিংহ), ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ (নিবন্ধন নম্বর ৪৬, প্রতীক আপেল), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (নিবন্ধন নম্বর ৪৭, প্রতীক মোটর গাড়ি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (নিবন্ধন নম্বর ২১, প্রতীক হারিকেন), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (নিবন্ধন নম্বর ৩৩, প্রতীক রিকশা), খেলাফত মজলিস (নিবন্ধন নম্বর ৩৮, প্রতীক দেয়াল ঘড়ি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ (নিবন্ধন নম্বর ২৭, প্রতীক গাভী) নির্বাচনে যাচ্ছে না।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে দুই তৃতীয়াংশ নির্বাচনে যাওয়ায় মনস্তাত্বিক লড়াইয়ে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে জোটসঙ্গী ছাড়া আসন্ন নির্বাচনে কেউ অংশ নেবে না— এরকম একটা শঙ্কার মধ্যে নতুন-পুরান মিলেয়ে ২৮টি রাজনৈতিক দল ভোটে যাওয়ায় অনেকটা স্বস্তিবোধ করছে ক্ষমতাসীন দল।
অপরদিকে, রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের দাবি, অধিক সংখ্যক দল নির্বাচনে গেলেও ভোটের হিসাবে তারা পিছিয়ে রয়েছে। নির্বাচনে না যাওয়া ১৬টি রাজনৈতিক দলের ভোট-ই বেশি। যদিও বিগত চারটি নির্বাচনের (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০২৮) ফলাফল সে তথ্য দিচ্ছে না। নানা তথ্য-উপাত্ত্ব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে নয়, ভোটের দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও উইকিপিডিয়ার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গড়ে ভোট পেয়েছে ৩৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, বিএনপি ৩৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ এই চার দল মিলে ৯১ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বাকি সব দলের সম্মিলিত ভোট ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এই ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ ভোট যেসব দলের, তাদের অধিকাংশই এবার নির্বাচনে যাচ্ছে। সেদিক থেকে হিসেব করলে নির্বাচনে যাওয়া ২৮টি দলের মোট ভোট প্রায় ৫৬ শতাংশ। আর নির্বাচনে না যাওয়া ১৬টি দলের মোট ভোট প্রায় ৩৭ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ ভোট জামায়াতের।
আসন প্রাপ্তির দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে নির্বাচনে যাওয়া দলগুলো। চারটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৫২৬টি আসন পেয়েছে। পক্ষান্তরে বিএনপি পেয়েছে ৪৭৯টি আসন। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১০৯ টি। অপরদিকে জামায়াত পেয়েছে মাত্র ৪০টি।
এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সম্মিলিত আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৩৫ এবং বিএনপি ও জামায়াতের সম্মিলিত আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১৯। এদিক থেকেও নির্বাচনে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় না যাওয়া দলগুলো পিছিয়ে রয়েছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সে বছর আওয়ামী লীগ ৩০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট। অন্য দলগুলোর মধ্যে জাকের পার্টি ১ দশমিক ২২, ইসলাম ঐক্যজোট দশমিক ৭৯, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দশমিক ৭৬, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু) দশমিক ৫০, গণতন্ত্রী পার্টি দশমিক ৪৫, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ দশমিক ২০, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি দশমিক ১৯, সাম্যবাদী দল দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া যেসব দল এবার নির্বাচনে যাচ্ছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তারা সবাই মিলে মোট ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ওই বিছর বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর জামায়াত পেয়েছিল ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, জাতীয় পার্টি ১৬ দশমিক ৪০, ইসলামী ঐক্যজোট ১ দশমিক শূন্য ৯, জাকের পার্টি শূন্য দশমিক ৪০, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু) দশমিক ১২, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট দশমিক শূন্য ৬, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ভোট পায়। এ বছর বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩৩ দশমিক ৬১ এবং জামায়াত ভোট ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ ভোট।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ, ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট (জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন ইসলামী দলগুলোর জোট) ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, ইসলামী ঐক্যজোট দশমিক ৬৮, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। জাকের পার্টি ১ হাজার ১৮১ ভোট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৫৮২ ভোট, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ৪৪২ ভোট, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি ৩৮২ ভোট পায়। অন্য দলগুলো, যাদের অধিকাংশই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তারা পায় ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট। এ বছর বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং জামায়াত পেয়েছিল ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪, জাতীয় পার্টি ৭ দশমিক শূন্য ৪, বিকল্পধারা বাংলাদেশ দশমিক ২১, জাকের পার্টি দশমিক ১৯, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি দশমিক ১৫, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ দশমিক ১৫, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট দশমিক শূন্য ৫, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কল্যাণ পার্টি ও তরিকত ফেডারেশন দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ভোট পায়। এ ছাড়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টি দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ১ হাজার ১১৩ ও ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১ হাজার ২০ ভোট পায়। অন্য দলগুলো যাদের অধিকাংশই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তারা পায় ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ ভোট। এ বছর বিএনপি পায় ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট এবং জামায়াত পায় ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট।
অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের হিসাব সবসময় এক রকম থাকে না। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট শুধু বেড়েছে। বিএনপির ভোট কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে। জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতের ভোট ক্রমন্বয়ে কমেছে। সুতরাং বিগত দিনের পরিসংখ্যান দিয়ে আগামী দিনের হিসাব কষা সমীচীন নয়।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনকার বাস্তবতায় পূর্বের পরিসংখ্যানের কোনো মূল্য নেই। ভোট এবং জনভিত্তির দিক থেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি আগের জায়গায় থাকলেও জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত আগের জায়গায় নেই। এই দুই দলের ভোট এবং জনভিত্তি অনেকাংশে কমেছে।’
‘সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে নিয়ে। এই দুই দলের যেকোনো একদলকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচন হবে না, উত্তর কোরিয়ার নির্বাচন হবে’— বলেন বদিউল আলম মজুমদার।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম