প্রশ্নব্যাংকের ২ কোটি টাকা ভাগভাগি, বাদ পড়েনি কেউ!
৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:২৮
যশোর: যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রশ্নব্যাংকের প্রায় ২ কোটি টাকা থোক হিসেবে ভাগ করে নিয়েছে সবাই। আয়ের ২০ শতাংশ টাকার স্থলে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ নিয়েছেন। শুধু তাই-ই নয়, ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এরিয়া তুলে ভাগাভাগি করা হয়েছে। সেখানে সুইপার থেকে চেয়ারম্যান কেউ বাদ পড়েনি এই ভাগভাগি থেকে।
এমনিতেই পাবলিক পরীক্ষার পর প্রত্যেকেই একটা করে বোনাস পান, বোনাস পান দুই ঈদে ও বৈশাখি উৎসবেও। এরওপর রয়েছে অন্যান্য আয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহে হিসাবের বাইরে প্রত্যেকেই সর্বনিম্ন এক লাথ থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ পর্যন্ত টাকা পেয়েছেন। এই টাকা পাওয়ার পর এটা নিয়ম না অনিয়ম, সে বিষয়ে কেউ আর মুখ খুলছেন না। তবে সম্প্রতি যারা পিআরএল বা অবসরে গেছেন বা বদলি হয়েছেন- তাদের অনেকের মনোকষ্ট রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে দেনদরবারও করেছেন। কিন্তু সোজা জবাব, অতীতে যেভাবে হয়েছে এখনো সেভাবে হচ্ছে, নিয়ম ভাঙা হয়নি।
সূত্র মতে, প্রশ্ন ফাঁস রোধ ও বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা পদ্ধতি আধুনিকীকরণ করার ধাপ হিসেবে প্রশ্ন ব্যাংক চালু করে যশোর শিক্ষা বোর্ড। এর আগে কোনো বোর্ড এ জাতীয় উদ্যোগ নেয়নি। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তিনি যে বিষয়ে পড়ান সে বিষয়ের উপর প্রশ্ন করে জমা দিতে পারেন এই ব্যাংকে। প্রতিটি পরীক্ষার আগে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে প্রশ্ন কয়েকজন অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে মডারেশন সেট আকারে তৈরি করে বোর্ড। বোর্ডের ১০ জেলার যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ সাপেক্ষে কোড ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সে প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির বার্ষিক, অর্ধবার্ষিক বা এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রিটেস্ট বা টেস্ট পরীক্ষা নিতে পারে। পরীক্ষার দিন সকালে এই প্রশ্ন পায় প্রতিষ্ঠান। তাই ফাঁস বা অন্যান্য সমস্যা থেকে নিরাপদ থাকে পরীক্ষা পদ্ধতি। আবার বিদ্যালয় বা কলেজ কর্তৃপক্ষও প্রশ্ন করা, ছাপানোর ঝামেলা থেকে যেমন মুক্ত থাকে, তেমনি অপেক্ষাকৃত খরচও কম পড়ে। বোর্ড কর্তৃপক্ষও এই পদ্ধতি গ্রহণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে। এই প্রশ্নব্যাংক থেকে প্রতি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীপ্রতি এক সেট বাবদ ১০ টাকা হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর জন্য টাকা পরিশোধ করতে হয়।
২০১৬ সালে যখন এই পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় তখন বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিল যে, প্রশ্ন বিক্রির আয় থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাবেন। তাছাড়া যে প্যানেল এই প্রশ্ন ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করবেন তারা আলাদাভাবে আরও কিছু অর্থিক সুবিধা পাবেন। এভাবে চললেও খুব সমস্যা হচ্ছিল না। সম্প্রতি দেখা যায়, প্রশ্ন বিক্রি বাদ আয় বেড়েছে অনেক।
তবে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দিয়ে ২০ শতাংশের পরিবর্তে আয়ের ৬০ শতাংশ গ্রহণের জন্যে অনুরোধ জানান। সে অনুযায়ী বোর্ড কমিটি ও বোর্ডের অর্থ কমিটির কাছে এ প্রস্তাব তোলা হয় চলতি বছর। এমনকি প্রস্তাব পাসও হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে নভেম্বর মাসে এরিয়া আকারে ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রশ্ন ব্যাংকের আয়ের বর্ধিত ৪০ শতাংশ (নিয়মিত ২০ শতাংশ ছাড়া) প্রায় ২ কোটি টাকা তোলা করা হয়। তবে অনেকেরই কিছুটা কষ্ট রয়েছে যে, ২০ শতাংশের পরিবর্তে ৬০ শতাংশ করায় প্রতিষ্ঠানের লাভের চেয়ে ব্যক্তি পাওয়াকে বড় করে দেখা হচ্ছে।
এই টাকা থেকে একজন ঝাড়ুদার যেমন লক্ষাধিক টাকা পেয়েছেন তেমনি ২য় শ্রেণির কর্মকর্তারাও দেড়লক্ষাধিক টাকা পেয়েছেন। বোর্ডের চাকরিবিধি অনুসারে চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছাড়া কারও কথা বলার এখতিয়ার না থাকায় কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। একজন জানান, তিনি দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন; একজন বলেন তিনি ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। ৪র্থ শ্রেণির এক কর্মচারী জানান, তিনি প্রায় একলাখ টাকা পেয়েছেন। তবে টাকা পাওয়া বা নেওয়ার বিষয়টি কোনোরকমে স্বীকার করলেও কেউ বিস্তারিত তথ্য জানাতে রাজি হননি। তারা জানিয়েছেন, টাকা সবাই খুশি।
তবে এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন ২০১৬ সাল থেকে যারা বদলি হয়েছেন বা পিআরএল বা অবসরে গেছেন তাদের একটি অংশ। তাদের দাবি, এই সময়ে তারা কাজ করেছেন এবং এই টাকার হকদার তারাও। তাদের মতে, মাত্র কয়েকমাস হলো বদলি এসে অনেকে সাত বছরের সুবিধা ভোগ করেছেন। এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ একটি অংশ বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে গেলেও পাত্তা পাননি।
এ বিষয়ে সাবেক কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম ও শরীফ আব্দুল্লাহ সারাবাংলার এই প্রতিনিধির কাছে তাদের ক্ষোভের কথা জানান। তারা বলেন, ‘৩৭ জনকে এই টাকার অংশ থেকে বাদ রাখা হয়েছে।’ তারা এ ব্যাপারে বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে কথা বলতে গেলেও তিনি জানিয়েছেন, ‘অতীতে যেভাবে চলেছে সেভাবে ব্যবস্থা হয়েছে। অতীতেও এ জাতীয় টাকা বণ্টনের ক্ষেত্রে বোর্ডে কর্মরতরাই সুবিধা পেয়েছেন। চলে যাওয়ারা পাননি, এখনো তা অব্যাহত আছে। তবে তারা এ নিয়ে ফের চেয়ারম্যানের কাছে যাবেন বলে জানান।
বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব আয়ের লভ্যাংশ ২০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে দুই কোটি টাকা তুলে তা বণ্টনের কথা স্বীকার করেন। সারাবাংলাকে তিনি জানান, টাকা বাড়ানোর বিষয়টি বোর্ডের অর্থ কমিটি ও বোর্ড কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। তার পর তা পাস হয় ও নেওয়া হয়। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।
তিনি আরও জানান, অতীতেও বোর্ডের টাকা বণ্টনের ক্ষেত্রে বদলি হওয়া অথবা অবসরে যাওয়াদের বিষয়টি বাদ রাখা হয়েছে। অতীতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই টাকা ভাগ করা হয়েছে। নতুন কোনো নিয়ম চালু হয়নি। তবে প্রশ্ন ব্যাংক খাতে মোট কত আয়, কীভাবে তা ব্যয় হয়, কত সেট প্রশ্ন এ পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে- এসবের কোনো উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বোর্ড চেয়ারম্যান।
সারাবাংলা/পিটিএম