‘টানাটানির রাজনীতি’তে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ইসলামী আন্দোলন
৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:০১
ঢাকা: ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)— দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলই চেয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ তাদের সঙ্গে থাকুক। সবাই নিজেদের দিকে টানছিল ইসলামী আন্দোলনকে। তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে এই টানাটানি।
বিশ্লেষকদের মতে, সাংগঠনিক শক্তি, জনসমর্থন, অনুগত কর্মী বাহিনী, জনভিত্তি, সারাদেশে বিস্তৃত সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক, সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা, সর্বোপরি যেকোনো ইস্যুতে ডাকা কর্মসূচিগুলোতে রেকর্ডসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতির কারণে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ইসলামী আন্দোলন। সে কারণেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় থাকার জন্য, এমনকি সংসদে বিরোধী দলের স্থান পাকাপোক্ত করার জন্য যেকোনো মূল্যে ইসলামী আন্দোলনকে পাশে পেতে উদগ্রীব ছিল সবাই।
এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি চলতি বছরের শুরুতেই ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। বিএনপি চেয়েছিল সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে ইসলামী আন্দোলনকে পাশে পেতে। আর জাতীয় পার্টি চেয়েছিল ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গঠন করে সংসদে বিরোধী দলের স্থান পাকাপোক্ত করতে।
এ বছরের শুরুর দিকে ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশালের চরমোনাইয়ে অনুষ্ঠিত মাহফিলে গিয়ে পীরের দরবারের মেহমানখানায় ভোজের ফাঁকে চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুযোগ পান বিএনপি নেতারা। এই সুযোগে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা আলোচনা করেন।
সেদিন বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হোসেন খান এবং বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবুল কালাম।
ওই সময় আবুল হোসেন খান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা চরমোনাই পীর সাহেবের দাওয়াত পেয়ে মাহফিলে গিয়েছিলাম। পরে সেখানে রাজনৈতিক অনেক বিষয় নিয়ে খোলোমেলা ও প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। যেহেতু আমরা রাজনীতি করি, সেটা তো হবেই।’
দলীয় সূত্রমতে, সেদিনের সেই ‘খোলোমেলা ও প্রাণবন্ত আলোচনা’-ই শেষ নয়, ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপির একাধিক নেতা ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। কখনো দলটির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, কখনো যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কখনো বা যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেন। দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেন। যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হওয়ার প্রস্তাব দেন।
‘টানাটানির’ এই রাজনীতিতে পিছিয়ে ছিল না সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। অতীতে (২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন) ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করার ‘সুখকর স্মৃতি’কে কাজে লাগিয়ে এবারও তারা চরমোনাই পীরের দলকে পাশে পেতে চেয়েছিল। যতদূর জানা যায়, গত ২৬ অক্টোবর রাতে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মসীহ্ ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এ বৈঠকে আগে-পরে রওশন এরশাদ গ্রুপ ও গোলাম মুহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) গ্রুপের একাধিক নেতা ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কখনো সরাসরি, কখনো টেলিফোনে কথা বলেন। সবারই মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী আন্দোলনকে নিজেদের পক্ষে টানা।
তবে এই ‘টানাটানির রাজনীতি’তে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। যেকোনো মূল্যে তারা ইসলামী আন্দোলনকে নির্বাচনে নিতে চেয়েছিল। এ লক্ষ্যে দলের একাধিক নেতা বারবার চেষ্টা করেছেন ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ও অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। কুশলাদি বিনিময়ের একপর্যায়ে রাজনৈতিক আলাপ শুরু হলে কৌশলে সেটি এড়িয়ে যান ইসলামী আন্দোলনের আমির।
পরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে থাকা নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ইসলামী আন্দোলনকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য। রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী ওই নেতার সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সৌজন্য সাক্ষাৎ হলেও যে উদ্দেশে তাকে পাঠানো হয়েছিল, তা সফল হয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাননি ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা।
সর্বশেষ ২১ অক্টোবর সরকারের পক্ষ থেকে আরেকটি প্রতিনিধি দল ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। এ প্রতিনিধি দলটিও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের জন্য ইসলামী আন্দোলনকে প্রস্তাব দেয়। একদিন পর ২৩ অক্টোবর ফের মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীসহ ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহম্মেদ সেখ ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সরকারের প্রতনিধি দলের এক সদস্য।
এরপর ২৭ অক্টোবর প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য সরসারি ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে দেখা করেন এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসার অনুরোধ জানান। সর্বশেষ ৩ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশের আগের দিন আবারও দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার অনুরোধ করেন প্রতিনিধি দলের ওই সদস্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের এসব সদস্যদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ দিলেও সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে আগে বসার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি ছিল ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের। কোনো অবস্থাতেই তারা নিজেদের রাজনৈতিক নীতি, কৌশল ও আদর্শের সঙ্গে আপস করতে চাননি। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জাতীয় সরকারের অধীনে ভোট গ্রহণ এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের যে শর্ত দিয়েছিলেন, তার বাইরে যেতে রাজি হননি ইসলামী আন্দোলনের নেতারা।
সে কারণে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠকে বসতে রাজি হননি তারা। আসন অথবা ফান্ড— কোনো কিছুই তারা চান না। বরং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেদের জনসমর্থন ও জনভিত্তি যাচাই করতে চান।
এমন অনড় অবস্থানের কারণেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বা যুগপৎ আন্দোলনে যাননি ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। তাদের মতে, কোনো একটি বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়লে নিজেদের শক্তি, সামর্থ্য, ভোট ও সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকবে না।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং দলের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই দলটা যারা করে, তারা কোনো কিছুর বিনিময় চায় না। দিল দিয়ে দল করে। এখন আমরা যদি নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে কোনো দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাই, তাহলে আমাদের ওই কর্মী-সমর্থকেরা বড় কষ্ট পাবে। আমাদের ওপর থেকে তাদের আস্থা উঠে যাবে। সে কারণে কারও ডাকেই আমরা সাড়া দেইনি। তবে সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে যৌক্তিক বিরোধিতার জায়গাটা ঠিক রেখেছি।’
মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী বলেন, ‘আমরা তো ক্ষমতার রাজনীতি করি না। আদর্শের রাজনীতি করি। যারাই আাদের কাছে আসে, তারাই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসে। সেটা কী, তা আপনারা বুঝতে পারেন। আমরা আসলে ওই ধরনের রাজনীতি করতে চাই না।’
জানতে চাইলে দলের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোটামুটি সব দলই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরাও সবার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ ও সৌজন্যতা দেখিয়েছি। কিন্তু কোনো দলের সঙ্গে আমরা রাজনৈতিক ঐক্য বা জোট করতে যাইনি। আমরা আমাদের নীতি ও আদর্শ ঠিক রেখে রাজনীতি করছি। কেউ আমাদের শত্রু না। আমাদের কাছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই নিরাপদ।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
আওয়ামী লীগ ইসলামী আন্দোলন টানাটানির রাজনীতি বিএনপি ভোটের রাজনীতি রাজনীতি