‘ভোটাধিকার নিয়ে গরিবদের চিন্তা নেই, চায় উন্নয়ন-ভাতের নিশ্চয়তা’
৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৪০
ঢাকা: পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, গরিব মানুষ সুশাসন ও ভোটের অধিকার নিয়ে চিন্তিত নয়। তারা চায় উন্নয়ন ও ভাতের নিশ্চয়তা। সুশাসন ও ভোটাধিকার সুশীল সমাজের মাথা ব্যথার কারণ হলেও সাধারণ মানুষের নয়। তারা টিউবওয়েল চায়, ভালো টয়লেট চায়, কমিউনিটি ক্লিনিকে ভালো ভালো ওষুধ চায়; ছেলেমেয়েরা যাতে স্কুলে যাতে যেতে, তারা সেগুলোই চায়। তাদের চাওয়া আর নাগরিক সমাজের চাওয়ার মধ্যে ব্যাপক ফারাক।
বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর লেকশোর হোটেলে ‘অ্যানুয়াল বিআইডিএস কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। আগামী শনিবার পর্যন্ত এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউকে’র অলস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এসআর ওসমানি। এছাড়া দিনব্যাপী ছয়টি সেশনে আটটি পেপার উপস্থাপন করা হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘মাহাথির মোহাম্মদ ও সিঙ্গাপুরের লিকুয়ান ইউ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। তারা উন্নয়নের ক্ষেত্রে রোল মডেল তৈরি করে গেছেন। সেখানেতো কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে বলা হয় স্বৈরশাসক। প্রশ্ন হলো উন্নয়নের দরকার আছে কিনা? দীর্ঘদিন একটি রাজনৈাতক দল সরকারে থাকায় মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে কিনা?’
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন দিয়ে একটি দেশের সব কিছুই বিচার করা যায় না। বিষয়টি হলো সমাজের একটি বড় পরিবর্তনের জন্য কিছু করলে সেটি মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। উন্নত দেশে সবাই পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করে। আমাদের মতো দেশে পরিবর্তনকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। ফলে সহিংস ঘটনা ঘটে। অর্থনীতিতে নানা পরিবর্তন আসে, যা সমাজ বা জনগণকে মেনে নিতে হয়। যখনই সমাজ পরিবর্তন মানতে চায় না তখন অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। অথচ পরিবর্তন ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
প্রফেসর এসআর ওসমানি বলেন, ‘বিচার ব্যবস্থা ও স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে আরেরকটি নিশ্চিত করা অসম্ভব। আমরা যেহেতু দরিদ্র দেশ। তাই আমরা উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। বিচার ও স্বাধীনতাকে পরের জন্য রেখে দিচ্ছি। সব মানুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আমরা যদি সব মানুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন না করি তাহলে সমাজে বৈষম্য বাড়বে। যা অর্থনৈতিক বৈষম্যও বাড়াবে। এই বৈষম্য কমাতে আমাদের কাঠামোগত ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ দরকার। ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের বৈষম্য আছে। ব্যাংক, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে।’
তিনি বলেন, ‘জেন্ডার বৈষম্য আছে। নারীদের সেভাবে লেবার ফোর্সে সুযোগ দেওয়া হয় না। আমাদের লেবার ফোর্স পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় না। ফলে এটা শুধু আমাদের বর্তমানকেই নয়, বরং ভবিষ্যতেকে বাধাগ্রস্ত করে। আরেক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শ্রম অধিকার। বেটার পে অ্যান্ড বেটার ওয়ার্ক কন্ডিশন। এটার কারণে শ্রমিকেরা তাদের কর্মদক্ষতার সর্বোচ্চটা দিতে পারে না। তাদের মানসম্মত কাজ ও কাজের গুণাগুণ নষ্ট হয়। আপনি যদি তাদের ভালোভাবে মূল্যায়ন না করেন, তাহলে তাদের সক্ষমত কখনোই বাড়বে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনটা বেশি জরুরি? উন্নয়ন, স্বাধীনতা না বিচার ব্যবস্থা। আমাদের পরামর্শ থাকবে উন্নয়নের চেয়ে স্বাধীনতা ও বিচার ব্যবস্থায় বেশি প্রাধান্য দেয়া। সরকার যদি স্বাধীনতা ও বিচার ব্যবস্থার যত্ন নেয়। জনগণ নিজেই উন্নয়নের দায়িত্ব কাঁধে নেবে।’
বিনায়ক সেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, গণতন্ত্র না থাকলে মানুষের মন পাথরের মতো হয়ে যায়। এজন্য গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ। এখন বিশ্বব্যাপী আয় বৈষম্য বাড়ছে। এখন ভাবা দরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক বিষয়ে। জনগণ আগে উন্নয়ন চায় নাকি গণতন্ত্র চায়, সেটির মতামত নেওয়া দরকার।’
অপর একটি অধিবেশনে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সেগুলো হলো- মুদ্রাাস্ফীতি কমিয়ে আনা, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অনেক উচ্চস্তরে সংরক্ষণ এবং পুনর্গঠন করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কার।’
তিনি বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদী সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত সমস্যা তৈরি করছে। যেমন- অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকিং খাত এবং রাজস্ব প্রশাসনের দুর্বল অবস্থার কারণে জটিল হচ্ছে আর্থিক খাতের সমস্য। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে খুব বেশি কিছু করা না গেলেও প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষের কষ্ট হলেও রাজস্ব আদায় বাড়াতে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া বাজারভিত্তিক সুদের হার নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার সঙ্গে একীভূত বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নিশ্চিত করার জন্য বাজারের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের বকেয়া পেমেন্ট নিয়মিত বা পুনর্গঠন করতে হবে। ব্যাংকিং এবং বৃহত্তর আর্থিক খাতের পুনর্গঠন এবং কর ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করার জন্য ব্যাপক মধ্যমেয়াদী সংস্কার কর্মসূচির প্রয়োজন হবে।’
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশের আর্থিক খাত অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। এর সংস্কার প্রয়োজন। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি বিশাল বোঝা খেলাপি ঋণ। এছাড়া তারল্য সংকটও আছে। কিছু ব্যাংক খুব একটা জবাবদিহিতা ছাড়াই দেউলিয়া হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।’
অধিবেশনের সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত উল্টো রথে আছে। যেমন- ব্যাংকের পরিচালক একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি হতে পারবেন। এটি ঠিক নয়। এছাড়া সার্বিক অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা আছে।’
অধিবেশনে আলোচকরা বলেন, মানুষের কষ্ট হলেও জাতীয় নির্বাচনের পর রাজস্ব আদায়ে কঠোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় অত্যন্ত কম। জিডিপির মাত্র ৭/৮ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের হার নিয়ে বাংলাদেশ কিভাবে উন্নত দেশে যাওয়া স্বপ্ন দেখে, সেটিও বড় প্রশ্ন। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা আছে। এ সব বিষয় মাথায় রেখেই আগামীতে যে সরকারই আসুক না কেন কার্যকর পদক্ষেপের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।