‘হলফনামার হিসাব আলাউদ্দিনের চেরাগের কাহিনীর মতো’
১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:৪১
ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের হিসাব ‘আলাউদ্দিন চেরাগের কাহিনীর মতো’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের হলফনামার হিসাব চিত্র তুলে ধরে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আসন্ন একদলীয় পাতানো নির্বাচন উপলক্ষে তাদের মন্ত্রী-এমপি-ডামি-উচ্ছিষ্টভোগী স্বতন্ত্রদের হলফনামা পড়লে মনে হয় যেন আরব্য উপন্যাসের সেই বিখ্যাত আলাউদ্দিন চেরাগ, সেই কাহিনী পড়ছিলাম। কারওটা দেখলে মনে হয় সাদ্দাদের বেহেশতে তারা বসবাস করছেন। তাদের বাড়ি-গাড়ি, বিদেশে অভিজাত এলাকায় তাদের অ্যাপার্টমেন্ট, তাদের ডুপ্লেক্স— সবকিছু মিলেই মনে হয় যে তারা সাদ্দাদের বেহেশতে বসবাস করছেন।’
তিনি বলেন, ‘নিশিরাতের ভোট ডাকাত সরকারের পাঁচ বছর থেকে ১৫ বছরের মন্ত্রী-এমপি ও তাদের নেতারা অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অনেকে আঙুল ফুলে কলা গাছ নয়, বট গাছ হয়েছেন। তাদের স্ত্রী-সন্তান-শ্বশুর-শাশুড়িরাও টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছে।’
রিজভী বলেন, ‘সাধারণ ব্যবসায়ীদের লোকসান হলেও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকদের কোনো লোকসান নেই। আওয়ামী রাজনীতি এমন একটি ব্যবসা যেখানে কোনো ঝুঁকি নেই এবং লোকসান হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। যে ব্যবসাই করছেন, তাতেই লাভ আর লাভ। শেয়ার ব্যবসায় তারা কেউ ক্ষতির মুখোমুখি হননি। কৃষি খামার ও মাছের ব্যবসাতেও বহু গুণ লাভ করেছেন। স্বামীদের ব্যবসা দেখাশোনা করতে গিয়ে স্ত্রীরাও কোটি কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘হলফনামা ধরে প্রতিদিন প্রাত্যহিক সংবাদপত্রে নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশ হচ্ছে তা দেখে জনগণের চক্ষু চড়কগাছের অবস্থা। তারা ভাবতে থাকে, আমরা কি একটা বাস্তব জগতে বাস করছি? এ যেন সেই রূপকথার জগত! নাকি কল্পনার স্বর্গরাজ্যে বাস করছি! এটাও সম্ভব! একেকজন মানুষের সম্পদ দুই শ গুণ, তিন শ গুণ, চার শ গুণ, পাঁচ শ গুণ, কেউ আবার পাঁচ বছরে সাত শ গুণ সম্পদেরও মালিক হয়েছেন।’
রিজভী বলেন, ‘অবস্থা এমন হয়েছে যে টাকার পাহাড়ে ঘুমান মন্ত্রী-এমপি-নেতারা। যে মন্ত্রী-এমপি নিজেকে কৃচ্ছ্রতাসাধনের বরপুত্র বলে জাহির করতেন, কিংবা যিনি জনসমুখে সততার পরাকাষ্ঠ প্রদর্শনের নাটক করতেন, তাদের শঠতার বীভৎস বিগ্রহ জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। যারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের প্রায় সবারই নগদ অর্থকড়ি-বিত্ত সম্পদ দ্বিগুণ থেকে প্রায় হাজার গুণ স্ফীত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় কারও হয়েছে সম্পদের পাহাড়ৃ, কারও গাড়ির বহর। ১০ বছর আগে যে মন্ত্রীর হলফনামায় হাজারের ঘরে ছিল বার্ষিক আয়, তিনিও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সবাই জানি, তাদের হলফনামায় সম্পদের সামান্যই প্রদর্শন করা হয়েছে। অবৈধ অর্থ, বিদেশে পাচার করা অর্থ, সেকেন্ড হোম, বিদেশে গচ্ছিত বেশুমার সম্পদের হিসাব নেই। যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের ব্রতই যেন লুটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া। লুটেরা রাজ্যের সম্পদ ছিটেফোটামাত্র এই হলফনামায় উঠে এসেছে। এমপি-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও অনেক তথ্য গোপন করছেন।’
রিজভী বলেন, ‘প্রতিটি হলফনামার অবস্থা তথৈবচ। হলফনামায় তারা যেসব সম্পদের কথা বলেছেন, এটা তো নগণ্য। আসলে বাস্তবে এর চাইতে আরও কত গুণ তাদের সম্পদ যেটা তারা আড়াল করেছেন! অর্থ-বিত্ত-সম্পদের ছিটেফোটার হিসাব দিলেও কোনো কোনো মিথ্যাবাদী মন্ত্রী-এমপি তাদের হলফনামায় দেশকে শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরিয়ে নিয়েছেন, যে শাসনামলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। শেখ হাসিনার আদর্শিক কিছু অটোপাস এমপি জনগণকে বেকুব মনে করেন। লুটের অর্থ-সম্পদ কম দেখাতে তাদের প্রায় সবাই গাড়ি, বাড়ি, জমি-জিরাত-খামার-বাড়ি ভাড়া, সোনা-দানা-অলংকারসহ সবকিছুর মূল্য অতি সামান্য দেখিয়েছেন। তাতে মনে হচ্ছে, তারা এখনো শায়েস্তা খাঁর আমলে বাস করছেন। সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুর রহমান চৌধুরী হলফনামায় তার ১০০ ভরি সোনার দাম দেখিয়েছেন মাত্র এক লাখ টাকা। সে হিসাবে তার কাছে গচ্ছিত প্রতি ভরি সোনার দাম পড়েছে এক হাজার টাকা। কুমিল্লা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২২ ভরি সোনার দাম দেখিয়েছেন ২১ হাজার টাকা। প্রতি ভরি সোনার দাম দেখিয়েছেন ৯৫৫ টাকা। এটা কি পাগলে বিশ্বাস করবে?’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী মাফিয়া রাষ্ট্রে এমপি বা মন্ত্রিত্ব যেন আলাদিনের চেরাগ। এই সাঁই সাঁই করে চোখের পলকে শনৈ উন্নতি, অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার নেপথ্য রহস্য জানে প্রতিটি মানুষ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন তার ছোট্ট উদাহারণ। প্রতিটি মন্ত্রী-এমপির বিমূর্ত অবয়ব তিনি। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার জন্য দেওয়া ৯৪ লাখ ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের হাতে তার মিন্টো রোডের ১১ নম্বর সরকারি বাসভবনে নির্মম মারধরের শিকার হয়েছেন পুলিশ সদস্যসহ তিন ভুক্তভোগী অসহায় ব্যক্তি।’
‘প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগ বাণিজ্য ও গুণ্ডামির এই খবর সব পত্র পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার পর টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে ১০ ডিসেম্বর সাতজনের কাছ থেকে নেওয়া সাড়ে ৯ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন প্রতিমন্ত্রী,’— বলেন রিজভী।
তিনি বলেন, ‘এসব অর্থ-সম্পদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন একেবারেই নীরব, অন্ধ। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জুলুমের প্রতিষ্ঠানবিরোধী দলের ওপর তার ধারালো তরবারি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। আর আওয়ামী লুটেরা গোষ্ঠীর সস্পর্কে তারা নীবর, নিশ্চুপ। তখন তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়।’
রিজভী বলেন, ‘দুদককে দলকানা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। তাদের কাজ হলো খুঁজে খুঁজে বিএনপি ও ভিন্নমতের সম্মানিত ব্যক্তিদের ঘায়েল করা। রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে এই তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে।’
তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো— মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের এই সম্পদ, এই টাকার পাহাড় কীভাবে গড়ে উঠেছে, আয়ের উৎস কী— এসব নিয়ে শেখ হাসিনার মাথাব্যথা নেই। জবাবদিহিতা নেওয়ার কেউ নেই। কারণ সবকিছু আওয়ামীময় নষ্টদের অধিকারে। বর্গীদের মতো লুটের রাজ্য ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে টপ টু বটম ব্যাস্ত।’
রিজভী বলেন, ‘তারা জনগণের সম্পদ চেটেপুটে খেয়ে পেট মোটা করতে এসেছে। লুটের শাসন স্থায়ী করতে খুন-গুম, হামলা-মামলা, গ্রেফতার, মিথ্যা সাজা দেওয়া হচ্ছে। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। একতরফা নির্বাচনের নাটক করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে অন্ধ হয়ে পড়েছে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৪০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে দাবি করে রিজভী বলেন, ‘৯টি মামলায় ৯২৮ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর