মাদকের আখড়ায় নতুন দখলদার, পুলিশ ঠেকাতে অস্ত্র হাতে পাহারা
২০ মে ২০১৮ ১৭:০৪ | আপডেট: ২০ মে ২০১৮ ১৭:১৪
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন নিহতের পরদিনই চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া ‘বরিশাল কলোনি’ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীদের আরেকটি সিন্ডিকেট। নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ন রাখতে প্রতিপক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মোকাবেলায় মাদক ব্যবসায়ীরা রাখছে আগ্নেয়াস্ত্র। এই আখড়া থেকে দিনে এক লাখেরও বেশি ইয়াবা বিক্রি হয় বলে তথ্য আছে পুলিশের কাছে।
নগরীর সদরঘাট থানা পুলিশ বরিশাল কলোনিতে অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের তিন সদস্যকে অস্ত্র ও মাদক সরঞ্জামসহ গ্রেফতার করেছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মো.আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি বরিশাল কলোনির মাদক বিক্রেতারা সাধারণত ছোরা-চাপাতি জাতীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত। আমরা অভিযান চালাতে গিয়ে অন্তত তিনবার মাদক ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হয়েছিলাম। প্রত্যেকবার তারা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এরপর তারা নিজেরা নিজেরা যখন মারামারি করত তখনও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত। কিন্তু এবার তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে। এটা আমরা অ্যালার্মিং বলে মনে করছি।
রোববার (১৯ মে) ভোরে গ্রেফতার হওয়া নিয়ন্ত্রক মাদক সিন্ডিকেটের তিন সদস্য হলেন, মো.হানিফ প্রকাশ খোকন (৩৫), কাজী মো. আব্দুল্লাহ (২৮) এবং খোকন কুমার দাস (৩২)। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, তিনটি কিরিচ এবং ৬২৩ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে।
সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, পিস্তলটি পাওয়া গেছে গুলি লোড করা অবস্থায়। প্রতিপক্ষ কিংবা পুলিশ অভিযান চালাতে গেলে যাতে তারা গুলি চালাতে পারে, সেই প্রস্তুতি তাদের ছিল। বন্দুকযুদ্ধে দুজনের মৃত্যুর মতো একটি ঘটনা যখন ঘটে গেছে তখন তারা কৌশল পাল্টে ধারালো অস্ত্রের পরিবর্তে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা শুরু করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা এই তথ্য পেয়েছি।
গত বৃহস্পতিবার (১৭ মে) রাতে বরিশাল কলোনিতে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। এরা হল, হাবিবুর রহমান ওরফে মোটা হাবিব (৫২) এবং মো. মোশাররফ (৩২)।
ওসি নেজাম জানান, বন্দুকযুদ্ধের রাত পার হওয়ার পরই বরিশাল কলোনির এক সময়ের নিয়ন্ত্রক মৃত ফারুকের ভাই শুক্কুরের লোকজন এসে এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। মূলত ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির কাঁচা টাকা আয়ের লোভেই তারা একসময় বেদখল থাকা এই মাদকের আখড়ার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
‘বরিশাল কলোনির’ দখল-বেদখল
বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রক মাদক সম্রাট ওরফে ফারুক ওরফে বাইট্যা ফারুক ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর সেই মাদক আখড়ার অদূরে আইস ফ্যাক্টরি রোডে র্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়। ফারুকের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন ইউসুফ। তার সঙ্গে ছিলেন সালামত। খসরু ছিলেন ফারুকের ম্যানেজার। খসরুর ভাই শুক্কুরও ছিলেন এই সিন্ডিকেটে। মূলত তারাই ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বরিশাল কলোনির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
সদরঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ রুহুল আমীন সারাবাংলাকে বলেন, ফারুক মারা যাওয়ার পর তার ভাই শুক্কুরের সন্দেহ হয়, ইউসুফ এবং সালামত মিলেই ফারুককে র্যাবের হাতে ধরিয়ে দেয়। এই সন্দেহ থেকে তাদের সিন্ডিকেটে ভাঙ্গন ধরে। শুক্কুর তাদের গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের নন্দেরখীল গ্রামে চলে যান। ম্যানেজার খসরু টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ইউসুফ ও সালামতের কাছে।
সর্বশেষ র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া হাবিব এবং মোশাররফ ছিলেন ইউসুফ-সালামত সিন্ডিকেটের সঙ্গে। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পর এই সিন্ডিকেটের সবাই পালিয়ে যান। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার রাত পার হওয়ার পরেই শুক্কুরের লোকজন বরিশাল কলোনিতে এসে নিয়ন্ত্রণ নেয় বলে জানান রুহুল আমীন।
ফারুকের মৃত্যুর পর শুক্কুর কয়েকবার বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয় বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, শুক্কুর গ্রামে চলে গেলেও ইয়াবার ব্যবসা বন্ধ হয়নি। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সড়কপথে আসা ইয়াবা খালাস হয় পটিয়ায় শুক্কুরের তত্তাবধানে। গ্রেফতার হওয়া কাজী আবদুল্লাহ শুক্কুরের পক্ষে খুচরা বিক্রেতা ও সেবনকারীদের কাছে ইয়াবা সরবরাহ করতেন। অস্ত্র নিয়ে মাদকের আখড়ায় মজুদ ইয়াবা পাহারা দেন হানিফ। আর খোকনের কাজ হচ্ছে ফারুকের প্রাইভেট কারে করে ইয়াবা বিভিন্নস্থানে নিয়ে যাওয়া।
বরিশাল কলোনিতে দিনে এক লাখের বেশি ইয়াবা বিক্রি হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ওসি নেজাম উদ্দিন।
তিনি বলেন, শাহ আমানত সেতুর দুইপাশে কর্ণফুলী থানা এবং বাকলিয়া থানার চেকপোস্ট আছে। সেই চেকপোস্টে নিয়মিত তল্লাশি হয়। সেজন্য ইয়াবার বড় চালান এখন সরাসরি চট্টগ্রাম নগরীতে আসে না। পটিয়ায় খালাসের পর সেগুলো বিভিন্নভাবে নগরীতে ঢুকে।
কলোনির ভেতরে অনেক ‘গিরা’
বরিশাল কলোনির ভেতরে মাদক ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণে ছোট ছোট স্পট আছে যেগুলোকে তাদের ভাষায় ‘গিরা’ বলা হয়।
সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, বরিশাল কলোনির ভেতরে মালি কলোনিতে ৮ নম্বর ব্লকে টিটির গিরা নামে একটি স্পট আছে যেটি মাদক ব্যবসায়ীদের অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহার হয়। শাকিল নামে একজন সেখানে নিয়মিত থাকেন। ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির হিসাবপত্র থাকে তার কাছে। এই কক্ষটি সবসময় বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে।
স্টেশন কলোনিতে শাকিলের খালাশ্বাশুড়ি নাজমা বেগমের একটি স্পট আছে যেটি নাজমার গিরা নামে পরিচিত।
এ ছাড়া স্বপন বড়ুয়ার গিরা, ডান্ডির গিরা, হালিম সাহেবের গিরা নামে আরও কয়েকটি স্পটের তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ওসি।
ল্যাঙ্গা লোকমান নামে একজন মাদক বিক্রেতার তথ্য পেয়েছে পুলিশ, যিনি মজুদ করা ইয়াবা পাহাড়ার দায়িত্বে থাকেন বলে জানিয়েছেন ওসি।
ওসি বলেন, সাথীর মার কোয়ার্টার নামে একটি স্পট আছে। দেখতে বাথরুমের মতো এই পকেট রুমে সবসময় ৭-৮ জন থাকে। তারাও মজুদ করা ইয়াবা পাহারার দায়িত্ব পালন করেন।
বরিশাল কলোনিতে যেসব মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে আছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন এবং প্যাথেড্রিন। হেরোইন আসে যশোর থেকে। ফেনসিডিল আসে কুমিল্লা থেকে। প্যাথেড্রিন আসে চট্টগ্রাম নগরী এবং আশপাশের এলাকার ওষুধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে। এর মধ্যে নকল প্যাথেড্রিনও আছে।
বিলাই মনির নামে একজন ফেনসিডিল, হেরোইন এবং প্যাথেড্রিনের নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে জানান ওসি।
সারাবাংলা/আরডি/একে