Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরাজয়ের দলিলে সই করছিলেন নিয়াজী, চট্টগ্রামে তখনো প্রাণপণ লড়াই

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:০৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সেদিনও ছিল শীতের সকাল। কুয়াশার আস্তিন ভেদ করে সেদিন যে সূর্যের আভা ছড়িয়েছিল, তাতে ছিল আনন্দ-বেদনার নানা রঙ। দেশকে মুক্ত করার জন্য যে মা অশ্রু আড়াল করে বুকের ধনকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, যুদ্ধ শেষের বার্তা পেলেও সেই সন্তানের খোঁজ আর মেলেনি। সেই মায়ের কাছে শীতের সকালটি ছিল বেদনার নীল রঙের। আবার যুদ্ধ শেষে যে সন্তান কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে হাতে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ফিরেছিল, তার মায়ের চোখেমুখে ছিল বিজয়ের আনন্দ।

একদিকে বাতাসে লাশের গন্ধ, মায়ের আহাজারি, বোনের আর্তনাদ; আরেকদিকে যুদ্ধজয়ী বীরদের নিয়ে দিকে দিকে উল্লাস। যুদ্ধের বিজয়গাঁথা নিয়ে নানা স্মৃতিচারণায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের দৃশ্যটি বর্ণিত হয়েছে এভাবেই, যেদিন বিশ্বের মানচিত্রে উদিত হয়েছিল লাল-সবুজের বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এদিন বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশ্বের পরাক্রমশালী পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ৯ মাসের হত্যাযজ্ঞ-ধ্বংসলীলা শেষে মুক্তিকামী বাঙালির প্রবল প্রতিরোধে পরাজয়ের দলিলে সই করতে বাধ্য হয়েছিল।

কিন্তু প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল চট্টগ্রামের। ঢাকায় যখন মিত্রবাহিনী আর মুক্তিবাহিনীর কাছে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করছিল, তখনো চট্টগ্রামকে শত্রুমুক্ত করতে প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন যৌথবাহিনীর বীর যোদ্ধারা। পথে পথে শত্রুর কামান-গোলা মোকাবিলা করে চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে পার হয়ে যায় ১৬ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। বুকপকেটে সযতনে লাল-সবুজ একটি পতাকা রেখেছিলেন মুক্তিবাহিনীর এক নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলাম। পরদিন সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেই পতাকা উড়িয়ে তিনি দেশ স্বাধীনের ঘোষণা দেন। তখনই চূড়ান্ত বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে চট্টগ্রাম।

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, সেই খবর তখনো চট্টগ্রামে সেভাবে পৌঁছেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা তো এখনকার মতো উন্নত ছিল না। ওয়্যারলেসে সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছালেও সাধারণ মানুষ কিংবা মুক্তিযোদ্ধারা সেটি জানতেন না। যাই হোক, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী বিভিন্ন এলাকা দখলমুক্ত করতে করতে ১৬ ডিসেম্বর মীরসরাই দিয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।’

‘এক গ্রুপ শুভপুর পার হয়ে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী হয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আসে। আরেক গ্রুপ মূল সড়ক দিয়ে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে এসে দুভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) দিকে যায়, আরেক অংশ শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রাতের মধ্যে ওই গ্রুপ ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছায়। চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল ক্যান্টনমেন্টে। এই পথটুকু পার হতে গিয়ে তাদের পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শেষ দিনে পাকবাহিনী পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করেছিল। তারা যেখানে যেভাবে পেরেছে, সাধারণ মানুষকে ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। কয়েক দফা সম্মুখযুদ্ধের পর যৌথবাহিনী ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে,’— বলেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী।

যৌথবাহিনীর অভিযানে চট্টগ্রাম হানাদারমুক্ত হওয়ার তথ্য উল্লেখ আছে গবেষক জামাল উদ্দিনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডের প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে।

‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। সমগ্র যুদ্ধ এলাকাকে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে মোট চারটি যুদ্ধাঞ্চলে ভাগ করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর এক নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করছিলেন ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্বে চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে গঠন করা হয় যৌথবাহিনীর ‘কিলো ফোর্স’। এ ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয় এক ব্রিগেড সেক্টর সৈন্য, বেঙ্গল রেজিমেন্টর দুটি ব্যাটেলিয়ন এবং ভারতীয় বাহিনীর দুটি ব্যাটেলিয়ন। যৌথ কমান্ডের অধিনায়কের দায়িত্ব পান ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ ও মেজর রফিকুল ইসলাম।

চট্টগ্রাম কাঁপানো ১৩ দিন

চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার অভিযান শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। এদিন মধ্যরাতে কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে একযোগে বিমান হামলা চালায় মিত্রবাহিনী। চট্টগ্রাম বন্দর ও তেলের ডিপোসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কুমিল্লায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করে মিয়াবাজার দখল করে নেয়। এরপর নবম বেঙ্গলের একটি দল লাকসামের দিকে এবং মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দল কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

৪ ডিসেম্বর ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। ভারতীয় বাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত পাক আর্মিদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। অন্যদিকে মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের সমর্থন নিয়ে পাক আর্মির ঘাঁটি ধ্বংস করে। নবম ডিভিশনের যোদ্ধারাও কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। পাক বাহিনী পিছু হটে দখলমুক্ত হয় কুমিল্লা বিমানবন্দর। তবে যুদ্ধে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়।

৫ ডিসেম্বর কুমিল্লা অঞ্চলে আখাউড়ার পাক সৈন্যরা একদিন অবরুদ্ধ থাকার পর আত্মসমর্পণ করে। পাকবাহিনীর কিছু সদস্য পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যায়। তিন দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করে এগোতে থাকে মিত্রবাহিনী।

৬ ডিসেম্বর কুমিল্লা অঞ্চলে মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ১১ বেঙ্গলের একাংশ চান্দুরার উত্তরাংশে রোড ব্লক করে। টানা দুই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও শাহবাজপুর এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাক আর্মি পিছু হটে শাহবাজপুর ত্যাগ করে। তবে যাওয়ার আগে তিতাস নদীর ওপর শাহবাজপুর সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। এদিকে একই দিন নোয়াখালী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করে ফেনীর উপকণ্ঠে পাক আর্মিদের ঘিরে ফেলে। উপর্যুপরি আক্রমণে টিকতে না পেরে পাক সৈন্যরা মীরসরাইয়ের শুভপুর সেতু অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরের দিকে চলে আসে। যাওয়ার আগে শুভপুর সড়ক ও রেলসেতু উড়িয়ে দেয় তারা। তবে ফেনী শত্রুমুক্ত হয়।

৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর ৪ বেঙ্গল বাংলাদেশের প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী ‘মুজিব ব্যাটারি’কে নিয়ে শুভপুর থেকে হেঁয়াকো হয়ে ফটিকছড়ি-নাজিরহাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে ১০ বেঙ্গল ফেনী-চট্টগ্রাম (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) দিয়ে সীতাকুণ্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল, দুই গ্রুপ একসঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাবে।

সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। ৮ ডিসেম্বর নারায়ণহাটে ৪ বেঙ্গল সদস্যরা পাক আর্মির প্রবল আক্রমণের সম্মুখীন হয়। তবে সম্মুখযুদ্ধে টিকতে না পেরে একপর্যায়ে পাকবাহিনী পিছু হটে। কিন্তু সেতু ধ্বংস করে দেওয়ায় নারায়ণহাটে আটকে পড়ে ৪ বেঙ্গল সদস্যরা। মিত্রবাহিনী চার দিনের প্রচেষ্টায় শুভপুর সড়ক সেতু ও নারায়ণহাট সেতু সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করে।

এদিকে ফেনী মুক্ত করে ৭ ডিসেম্বর ১০ বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নোয়াখালীতে অগ্রসর হন। তিন দিন ধরে সম্মুখযুদ্ধের পর রাজাকার-আলবদরদের একাধিক ঘাঁটি ধ্বংস করে ৯ ডিসেম্বর তারা নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করে।

একইদিন ৯ ডিসেম্বর সম্মিলিত বাহিনী শুভপুর দিয়ে ফেনী নদী অতিক্রম করে এবং মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জে অগ্রবর্তী সদর দফতর স্থাপন করে। জোরারগঞ্জ থেকে তিনটি গ্রুপ তিন ভাগে ভাগ হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে রেললাইন ধরে সীতাকুণ্ডে এবং মেজর ‍গুরুং ও মেজর ভাস্করের নেতৃত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুপাশ ধরে দুটি গ্রুপ চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ১০ ডিসেম্বর ভোরে বারইয়ারঢালা রেলস্টেশনে পৌঁছে। মেজর রফিকুল ইসলামের নির্দেশে তিনটি গ্রুপ মীরসরাইয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। অন্যদিকে ৯ ডিসেম্বর মীরসরাইয়ে রাত পার করে পরদিন ব্যাটেলিয়ন নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন মেজর রফিক।

১০ ডিসেম্বর সকালে সীতাকুণ্ডে পৌঁছালে ১০ বেঙ্গলের সদস্যদের দুভাগে ভাগ করা হয়। একটি অংশ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার জাফর ইমামের নেতৃত্বে হাটহাজারীর দিকে যায়। আরেকটি অংশকে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মার্চ করানো হয়। যার যার অবস্থান থেকে সব গ্রুপ চট্টগ্রাম শহরকে মুক্ত করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থাপনায় একাধিক গেরিলা আক্রমণ হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিএলএফ ও এফ এফ সদস্যরা।

১২ ডিসেম্বর কুমিরায় পাকিস্তান বাহিনীর শক্তিশালী ডিফেন্স সীমানায় পৌঁছায় মুক্তি ও মিত্রবাহিনী। ১৩ ডিসেম্বর সকালে পাক আর্মির স্থাপনায় একযোগে কামান হামলা শুরু হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে কুমিরা মুক্ত হয়, যার অবস্থান চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ১২ মাইল দূরে। একই দিন চট্টগ্রাম উত্তরের নাজিরহাটে হালদা নদীর পাড়ে ৪ বেঙ্গলের সদস্যদের সঙ্গে পাক সৈন্যদের তুমুল লড়াই হয়। নাজিরহাট শত্রুমুক্ত হয়।

১৫ ডিসেম্বর ৪ বেঙ্গলের সদস্যরা হাটহাজারী পৌঁছেন। সেখানে সীতাকুণ্ড থেকে এসে অবস্থান নিয়েছিল ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১০ বেঙ্গলের এক গ্রুপ। সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছায়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পাক বাহিনী সেখানে আত্মসমর্পণ করে। এরপর উভয় গ্রুপ সম্মিলিতভাবে নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে। অন্যদিকে একইদিন যৌথবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে ভাটিয়ারি এলাকায় পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাটিয়ারী থেকে ফৌজদারহাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ডিফেন্স ছিল। তাদের ভারী অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিপুলসংখ্যক সৈন্য ছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে তাদের ঘাঁটিতে যৌথবাহিনী মূল আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী চূড়ান্ত পরাজয়ের আগ মুহূর্তে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে সেতু-কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে রাখে। সেগুলো মেরামতের পর যৌথবাহিনীকে তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছে আঘাত হানতে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত লেগে যায়। তিন দিক থেকে আক্রমণ হয়।’

‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় জেসিও সুবেদার আজিজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ভাটিয়ারিতে পাক সেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ঠিক যে মুহূর্তে নিয়াজি ঢাকার রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে তখন চলছিল তুমুল যুদ্ধ। ভাটিয়ারীতে সুবেদার আজিজ কোম্পানির মাঝখানে এসে পড়ে পাক কামানের গোলা। মারাত্মক আহত হন সুবেদার আজিজ ও ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। পরে দুজনই মারা যান। সন্ধ্যার মধ্যেই পাক আর্মি সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জামাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাটিয়ারী-ফৌজদারহাটে শক্তিশালী পাকিস্তানি ডিফেন্স ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে কার্যত চট্টগ্রাম শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেটি শেষ করতে রাত হয়ে যায়। এরপর ভাঙা রাস্তাঘাট-সেতু এড়িয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় যৌথবাহিনীর সদস্যদের চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পরদিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর ভোর হয়ে যায়। মেজর রফিক চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পৌঁছান সকাল ৯টার পর। সেখানে বিএলএফ কমান্ডার আবু ছালেহ ছিলেন।’

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেজর রফিকের কাছে একটি লাল-সবুজ পতাকা ছিল। যুদ্ধের ‍পুরোসময় সেটা তিনি রেখেছিলেন বিজয়ের পর ওড়াবেন বলে। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেই পতাকাই তিনি ওড়ান। স্যালুট করেন সদ্যস্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকাকে। পুরো চট্টগ্রাম তখন বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাটের ওপর পতপত করে উড়তে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। আমরা এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি, আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয়, গৌরবের মুহূর্ত সেটা।’

১৭ ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজেই বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর সমপর্যায়ের সৈনিক ও তিন বাহিনীর আট হাজার ৬১৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আত্মসমর্পণ একাত্তর চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ বিজয় দিবস মহান বিজয় দিবস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর