কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড: ফেসবুক আটকে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ছবি
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:১৮
ঢাকা: নদীতে ভাসছে নিরীহ বাঙালির লাশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতায় এমন অসংখ্য মানুষের মরদেহ নদীর তীরে ভেসে আসে। আর সেই ভেসে আসা লাশই তুলে আনছিলেন একজন, যা ক্যামেরাবন্দি হয় নাম না জানা এক আলোকচিত্রীর।
২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা রহমান মুস্তাফিজ ফেসবুকে পোস্ট করেন। ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ ক্যাপশন দিয়ে ওই ছবিটি পোস্ট করা হলে ‘ভায়োলেন্ট অর গ্রাফিক কনটেন্ট’ আখ্যা দিয়ে ব্লার (ছবি ঢেকে) করে দেয় ফেসবুক।
শুধু এই একটি ছবি নয়, একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত বীভৎসতা ও যৌন নীপিড়নের ছবি শেয়ার করতে গেলেই আটকে দিচ্ছে ফেসবুক। এর ফলে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিতে ইতিহাসের এসব তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এসব ছবি শেয়ার করে ফেসবুক আইডি খোয়াচ্ছেন ব্যবহাকারীরা। প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা। বঞ্চিত হচ্ছে আগামী প্রজন্ম। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে সরকারকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমনই এক ঘটনার শিকার অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক রহমান রা’আদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ফেসবুক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিগুলো আটকে দিচ্ছে। বিশেষ করে গণহত্যা কিংবা শরণার্থী শিবিরের বেশকিছু ছবি আছে, ভিকটিম অব দ্য ওয়ার— এমন কিছু ছবি আছে, এগুলো তো আমরা পলিশ অবস্থায় আশা করতে পারি না। গত তিন-চার বছর ধরেই এ ধরনের ছবিগুলো ফেসবুকে শেয়ার করা যাচ্ছে না। তবে গত এক-দেড় বছর ধরে খুব বেশি হচ্ছে।’
রা’দ বলেন, ‘ফেসবুক তাদের কমিউনিটি ভায়োলেন্সের অজুহাতে এসব ছবি ব্যান করে দিচ্ছে। এ ছবিগুলো পোস্ট করলে সংশ্লিষ্ট আইডিগুলোকে ব্যান বা নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য কার্যক্রম সীমিত করে দিচ্ছে। এর প্রতিবাদে ফেসবুকে মেসেজ পাঠালে তারা জানিয়েছে, তারা তাদের নিয়ম চেঞ্জ করতে পারবে না। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা বড় বড় যুদ্ধের অনেক ছবিই ফেসবুকে ঘুরতে দেখি। সেগুলোকে কিন্তু কমিউনিটি গাইডলাইনের আওতায় ব্যান করছে না।’
‘কেন তাহলে শুধু মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোই, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্মমতায় আক্রান্ত ভিকটিমদের ছবিগুলোই ব্যান করবে, এই প্রশ্নগুলো এখন জাতীয় পর্যায় থেকে তোলা উচিত। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ফেসবুকের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়া উচিত। তাদের স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া উচিত, সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হয়ে তারা তাদের বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।’
আরেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ফারজানা ইয়াসমিন অপরাজিতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১২-১৩ সাল থেকে ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি করছি। আমার অভিজ্ঞতা, ২০১৮ বা ২০১৯ সাল থেকে ফেসবুক মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি আটকাতে শুরু করে। এখন এটা চরম পর্যায়ে চলে গেছে। এ কারণে অসংখ্যবার আমার আইডি ব্যান হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে কখনো দুদিন, কখনো এক সপ্তাহ, পরে এক মাস পর্যন্ত ব্যান হয়েছে।’
সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘সংগ্রামের নোটবুক’ চালান ফারজানা ইয়াসমিন অপরাজিতা। এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশের সবচেয়ে অনলাইন আর্কাইভ বলে দাবি তাদের। ফারজানা বলেন, ‘এখানে পোস্ট করার কারণে ছবি, বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরের ছবি পোস্ট করলেই তারা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডে ধরত, এখনো ধরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কপিরাইটের যন্ত্রণা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভিডিও বা ছবি যেগুলো ফ্রি কনটেন্ট, সেগুলোও আমরা এখন আর পোস্ট করতে পারি না। আমাদের সংগ্রামের নোটবুকের একজন ফাউন্ডার অ্যাডমিনের আইডি এসব কারণে ব্যান হতে হতে পার্মানেন্টলি ডিলিটই হয়ে গেছে। সে আইডি আমরা এখনো ফেরত পাইনি।’
এ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট মারুফ রসুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফেসবুকে মুক্তযুদ্ধভিত্তিক ছবি শেয়ার করার ক্ষেত্রে এখন দুটি ইস্যু দেখা যাচ্ছে— কপিরাইট ও ভায়োলেন্স ইস্যু। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যত ধরনের ছবি আছে, সবগুলোর কপিরাইট একটি প্রতিষ্ঠান (দৃক গ্যালারি) তাদের নামে নিয়ে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোকে নিজেদের ছবি বলে তারা ব্যবসা করছে। অথচ এই ছবিগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ, কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে তার কপিরাইট থাকতে পারে না।’
কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে মারুফ রসুল বলেন, ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের ধোয়া তুলে ফেসবুক ১৯৭১ সালের গণহত্যা ও যৌন নিপীড়নের ছবি শেয়ার করতে দেয় না। এটি তো আমাদের ইতিহাসের অংশ। অথচ এসব ছবি শেয়ার করতে গেলে ভায়োলেন্সের কথা বলে। কম্বোডিয়ার জেনোসাইডের একই ধরনের ছবি কিন্তু নামায় না। কম্বোডিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে ফেসবুকের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বাংলাদেশ সরকারও এই উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে উদ্যোগ নিলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। ফেসবুককে বুঝাতে হবে, এসব ছবি আমাদের ইতিহাসের অংশ, এগুলো আমাদের শেয়ার করতেই হবে।’
জানতে চাইলে সদ্য সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ফেসবুকে কোনো ভায়োলেন্সের ছবি বা পর্ন ছবি শেয়ার করা যায় না। হত্যা বা এ ধরনের ছবি শেয়ার করা যায় না। আমার কাছে এ ধরনের বহু অভিযোগ এসেছে। ছবি শেয়ার করার পর আইডি ব্লক করে দিয়েছে, ছবি সরিয়ে ফেলেছে। এগুলো এখন করছে এআই। কোনটি সঠিক ছবি বা কোন অনুভূতি সঠিক বা এগুলো যে সত্য— এআই তা বিশ্বাস করে না। এই অঞ্চলে ফেসবুকের যারা আছেন, সবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারাও কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়েছেন।’
ফিলিস্তিনে গণহত্যা কিংবা ইতিহাসের আরও গণহত্যার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করলেও কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডে আটকায় না— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ওরা তো দুমুখো সাপ। আমেরিকা তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। সঙ্গত কারণেই তারা চাইবে না এসব ছবি শেয়ার হোক। এসব ছবি শেয়ার হলে দায় তো তাদের ওপরও পড়বে।’
সদ্যসাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে আমি একটি প্রস্তাব দিয়েছি। ফেসবুক এখানে ব্যবসা করছে, কারও কোনো অনুমতি ছাড়াই ডলার নিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাদের আয় বাইরে নিতে হলে বিটিআরসির কাছ থেকে নো অবজেকশন লেটার নিতে হবে। আমি ডিও লেটারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে এই প্রস্তাব দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে ফোনেও একাধিকবার জানিয়েছি। এই কাজটি করা গেলে তাদের সঙ্গে বসার বা দর কষাকষির একটি সুযোগ তৈরি হতো। তাদের বলা যেত এ বিষয়গুলো মানা না হলে আমরা এনওসি দেবো না। তখন তারা বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মৌলিক ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের কথা না শুনে ফেসবুককে সর্বাত্মক সাহায্য করে যাচ্ছে।’
বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে অ্যানালাইেজন বাংলাদেশ লিমিটেডের দ্য ম্যান অব স্টিল (চেয়ারম্যান) রিসালাত সিদ্দীক সারাবাংলাকে বলেন, “ফেসবুকের অ্যালগারিদমটিই এমনভাবে সেট করা আছে সেখানে কোনো ভায়েলেন্স বা হত্যাযজ্ঞের ছবি শেয়ার করলে ছবিটি ঢেকে দেবে বা ব্লক করে রাখবে। এটি কোনো একক দেশের জন্যে পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে মুক্তিযুদ্ধের ছবি শেয়ার করার ক্ষেত্রে ফেসবুক যখন ছবিটি ব্লক করে দিচ্ছে, সবাই যদি এমন ছবি পোস্ট করে ‘আনফেয়ারলি ব্লক’ রিপোর্ট করে তাহলে হয়তো সেসব ছবির ক্ষেত্রে অ্যালগারিদমে পরিবর্তন আসতে পারে। সবাই এসব ছবি পোস্টের পর যদি এমন রিপোর্ট করতে থাকে, তাহলে সুরাহা আসতে পারে বলে মনে করি।”
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফেসবুকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশি একজন সারাবাংলাকে জানান, পলিসি বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ফেসবুকের এখন আর আলাদা করে কোনো কর্মকর্তা নেই। সাবহানাজ রশীদ দিয়া ফেসবুকের বাংলাদেশ বিষয়ক পাবলিক পলিসি ম্যানেজার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। প্রায় ছয় মাস ধরে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে নেই। বর্তমানে এই পদে নতুন করে কাউকে নিয়োগও দেয়নি ফেসবুক। তবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য ফেসবুকের নীতিমালাবিষয়ক কর্মকর্তা রয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে সম্পৃক্ত ওই কর্মকর্তা জানান, ফেসবুকের সঙ্গে সরকারের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সরকার চাইলে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড গণহত্যার ছবি ফেসবুক ভায়োলেন্স মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ছবি