ডিএসসিসি’র জন্ম নিবন্ধন: অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে জনভোগান্তি
২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:০০
ঢাকা: লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি ইউনিয়ন পূর্ব কাদমা গ্রাম। সীমান্তঘেঁষা এই অজ পাড়াগাঁয়ের আমেনা আখতার (ছদ্মনাম) ও তার দুই বছরের সন্তান পাসপোর্ট করবেন। তার জন্য জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজন ছিল। ১০ আগস্ট দুপুরে আবেদন করে বিকেলের মধ্যেই পেয়ে যান জন্ম নিবন্ধন সনদ। স্থানীয়রা বলছেন, চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকলে এমন অল্প সময়ের মধ্যে হলেও সাধারণত আবেদনের একদিনের মধ্যেই পাওয়া যায় জন্ম নিবন্ধন সনদ।
অন্যদিকে চলতি ডিসেম্বরে রাজধানীর নারিন্দার সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম) তার এক বছর বয়সী সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন। সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের জন্য মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন সনদও দরকার হয়। স্ত্রীর জন্ম নিবন্ধন ঢাকার বাইরে থেকে করাতে পারলেও খোদ রাজধানীর বাসিন্দা হয়েও আটকা পড়েন সাইফুল। অন্য সবার মতো অনলাইনে জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে গিয়ে দেখেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসিন্দাদের জন্য আলাদা নিয়ম!
সাইফুল জানতে পারেন, দেশের অন্য যেকোনো এলাকায় নাগরিকরা রেজিস্ট্রার জেনারেলের ওয়েবসাইটে গিয়ে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে পারেন। কিন্তু তাদের (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা) আবেদন করতে হবে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এটিও তিনি সরাসরি করতে পারেননি। একটি নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে তবেই আবেদন করতে পেরেছেন। তবে এই জন্ম নিবন্ধন সনদ পেয়েও তার কোনো লাভ হয়নি। কারণ যার জন্য এই সনদ সংগ্রহ, সেই পাসপোর্টের জন্য আবেদনই করতে পারেননি তিনি। ডিএসসিসির আলাদা এই ডাটাবেজের তথ্য যে পাসপোর্ট অধিদফতরের ডাটাবেজের সঙ্গে সংযুক্তই নয়!
শুধু সাইফুল ইসলাম বা তার সন্তানই নন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লক্ষাধিক বাসিন্দা পড়েছেন এমন ভোগান্তিতে। তারা বলছেন, আগে থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে ডিএসসিসি নিজের মতো করে জন্ম নিবন্ধনের আলাদা ডাটাবেজ তৈরি করায় এখন তাদের জন্ম সনদ কোনো দফতরেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এই সিদ্ধান্তকে তারা অদূরদর্শী ও অবিবেচনাপ্রসূত বলে অভিহিত করছেন। বলছেন, তাদের এমন সিদ্ধান্তের ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে বাসিন্দাদেরই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ অক্টোবর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব সার্ভারে জন্ম নিবন্ধন ও সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হচ্ছে। আবেদনে ভোগান্তি তো আছেই, তার ওপর সনদ পেয়ে তা কোনো কাজেই লাগছে না। শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, পাসপোর্ট করার মতো নানা ধরনের কাজ থমকে যায়।
এসব জটিলতায় শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন থেকে ইস্যু করা সনদ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মোট ২৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এপিআই (অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম ইন্টিগ্রেশন)-এর জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন হয়ে গেছে। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সার্ভার থেকে তথ্য যাচাই করতে পারবে। কিন্তু বাকি ২৪টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখনো ইন্টিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।
জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পাসপোর্ট করতে গিয়ে। সিটি করপোরেশন বলছে, পাসপোর্ট অধিদফতরের সঙ্গে এরই মধ্যে তাদের আলোচনা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই দফতরের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন সম্পন্ন হওয়ার আশা দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষের। তবে পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে বলছে, আলোচনা হলেও কবে থেকে ইন্টিগ্রেশন অর্থাৎ দক্ষিণ সিটির জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে পাসপোর্ট ইস্যু করা যাবে সেটি নিশ্চিত নয়।
প্রশ্ন উঠেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি ইউনিয়ন পরিষদেও যে সেবা কেন্দ্রীয়ভাবে পাওয়া যায়, সেই একই সেবা পেতে রাজধানী ঢাকার একটি অংশের বাসিন্দাদের কেন আলাদা প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে।
সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, অনেকদিন ধরেই জাতীয় সার্ভার ডাউন থাকায় জনভোগান্তি হচ্ছিল। এ ছাড়া কিছু ভুয়া জন্ম নিবন্ধন কার্ড ব্যবহারের অভিযোগও আসে তাদের কাছে। ওই সময় তদন্ততে বেরিয়ে আসে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে এই ভুয়া কার্ড দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় শাহবাগ থানায় জিডিও করে ঢাকা দক্ষিণ। তারপরই জন্ম নিবন্ধন নিজস্ব সার্ভারে আনার কথা বলেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তবে এর জন্য আলাদা কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। নিজস্ব সার্ভার ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এই সেবা চালু করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি, পাসপোর্ট তৈরিসহ ১৬টি মৌলিক সেবা পেতে জন্ম সনদ প্রয়োজন। এগুলো হলো— বিয়ে নিবন্ধন; সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ; ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু; ভোটার তালিকা প্রণয়ন; জমি রেজিস্ট্রেশন; ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা; আমদানি বা রফতানি বা উভয় লাইসেন্স ইস্যু; গ্যাস, পানি, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগপ্রাপ্তি; করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন); ঠিকাদারি লাইসেন্স ইস্যু; বাড়ির নকশা অনুমোদন; গাড়ি রেজিস্ট্রেশন; এবং ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সেবার সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন না করেই কেন তাড়াহুড়া করে এই সেবা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিল সিটি করপোরেশন— জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে জন্ম নিবন্ধনে জটিলতা দেখা দেওয়ায় আমরা নাগরিক ভোগান্তি কমাতে জন্ম নিবন্ধন নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে আসি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে একাধিক চিঠি লিখে তারপর নিজস্ব সার্ভারে আনা হয়। এখন আমাদের নাগরিকরা অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুততম সময়ে জন্ম নিবন্ধন করতে পারছেন।’
ডিএসসিসির এই কর্মকর্তা জানান, সেবা চালুর পর অক্টোবর মাসে সাত হাজার ৪৬৬ জন, নভেম্বর মাসে ১৫ হাজার ১৩৮ জন এবং ডিসেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে ২৮ হাজার ১০ জনকে জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে আড়াই মাসে ডিএসসিসি জন্ম সনদ ইস্যু করেছে ৫০ হাজারেরও বেশি। আরও লক্ষাধিক আবেদন তাদের সার্ভারে রয়েছে বলে জানান তিনি।
সনদ বিতরণ করলেও নাগরিকরা অন্য দফতরে গিয়ে সেবা না পাওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করেন মিজানুর রহমান। বলেন, ‘কোনো কাজ করতে গেলে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবেই। সেগুলো সমাধানেই আমরা এমন উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি দ্রুততম সময়ে এর সমাধান হবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর/রমু
জন্ম নিবন্ধন জন্ম নিবন্ধন সনদ ডিএসসিসি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পাসপোর্ট অধিদফতর রেজিস্ট্রার জেনারেল