বইপ্রেমীদের একটি দিন
২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:২০
ঢাকা: ডিসেম্বরের দুপুর, হেমন্তের মিঠে রোদ গায়ে মেখে দীর্ঘ যানজট পাড়ি দিয়ে সিলেট শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পৌঁছালাম। ঢুকেই পরিচিত এক রূপ দেখতে পেলাম সেদিনের। লাল সবুজে সেজেছে পুরো প্রাঙ্গণ, মৃদু শব্দে বাজছে দেশের গান। ছেলেমেয়েদের অনুসন্ধিৎসু ছুটোছুটি। প্রতিবছর ই তো এমন দেখি, এ আর নতুন কী? তবুও যেন অনুভূতিটা পুরোনো হয়না।
চারদিকে যেন বই বই গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেও সেদিন লাল-সবুজ শাড়ি পরেছিলাম। সেই বইপড়া উৎসবের পোস্টার, লাল-সবুজ পতাকা, শত শত শিক্ষার্থীদের উন্মাদনা, স্বেচ্ছাসেবকদের হাসিমুখে নিরলস প্রচেষ্টা, স্টেজে অনবরত মুক্তিযুদ্ধের গান চলা- এসব যেন প্রাণ নিয়ে এসেছিলো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে।
সেই প্রাণে ছিল আটশত চারজন বইপ্রেমীর উদ্যম, আগ্রহ এবং কৌতূহল। তখন সবার মাথায় আসল ভাবনা ছিল: কোন বই পাব আমরা? আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না, এবার অংশগ্রহণ না করলেও প্রতিবছর বইপড়া উৎসবে আসলে সবার প্রথমে এই ভাবনাটাই আমাকে মগ্ন রাখত। যাই হোক এবছর অংশগ্রহণ না করলেও কাজটা ছিল একটু ভিন্ন। আমরা স্বেচ্ছাসেবকগণ শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড় করানো থেকে শুরু করে তাদেরকে উৎসবের জন্য রিপোর্টিং করানো, হাতে পতাকা তুলে দেওয়া, সবকিছুর দিকনির্দেশনা দেওয়াসহ আরও যা আছে সে সবে ব্যস্ত ছিলাম। আমার কাছে বছরের এই দিনটি একটু অন্যরকম। কারণ এরকম বইপ্রেমীদের ভীড় আর বাকি দিনগুলোতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবগণও ভীষণ উৎসাহী ছিলেন, কয়েকজন অভিভাবক বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন কখন অনুষ্ঠান শুরু হবে, কখন বই প্রদান করা হবে ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে কয়েকটি বিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে শিক্ষকগণ ও এসেছিলেন৷ এসেছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা যারা বিভিন্ন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকদের মতামত নিচ্ছিলেন।
প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ আসার পরে শুরু হলো জাতীয় সংগীত। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইলাম। পরবর্তীতে অতিথিবৃন্দ তাদের মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করলেন সবার উদ্দেশ্যে। সিলেট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দীন খানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে- সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার(অতিরিক্ত সচিব) আবু আহমদ ছিদ্দিকী এবং সিলেট জেলা পরিষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমা চক্রবর্তী, ইনোভেরের প্রতিষ্ঠাতা ও মুখ্য সঞ্চালক রেজওয়ান আহমেদ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রেখেছিলেন ইনোভেটরের আরেক প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সঞ্চালক প্রণবকান্তি দেব। সবার বক্তব্যের মূলকথা ছিল: বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শিক্ষার্থীদের বইপড়ার কোনো বিকল্প নেই, বই পড়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের সৃজনশীলতাকে বৃদ্ধি করার পাশাপাশি দেশের ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
বক্তব্যের পালা শেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার অপেক্ষায় ছিল শত-শত বইপ্রেমীরা। সূর্য অস্ত যাবার পূর্বেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই প্রদান। মঞ্চে থরে থরে সাজানো বই। কর্মতৎপর ইনোভেটরের সদস্যরা। ওপাশে দীর্ঘ লাইন। সারি বেধে সবাই এক এক করে স্টেজে উঠে বই নিচ্ছিলো যখন মনে হচ্ছিল আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্নেরা উড়াউড়ি করছে আমারই চোখের সামনে।
এবার ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেলো শওকত ওসমান রচিত উপন্যাস ‘মুজিবনগরের সাবু’। অপরদিকে দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শাহরিয়ার কবির রচিত ‘পুবের সূর্য’ নামক উপন্যাসটি পেলো৷ কাঙিক্ষত বই গ্রহণ শেষে সবাই শহীদ মিনারের মঞ্চে একসাথে স্থিরচিত্র তোলার জন্য দাঁড়ায়।
দিনের আলো তখন বিদায় নেওয়ার পথে। এক হাতে বই আর অন্যহাতে পতাকা নিয়ে আবেগে-উচ্ছ্বাসে বাড়ি ফেরা… তখনও বাজছিল – ‘আমি বাংলার গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।’
সারাবাংলা/একে