চট্টগ্রাম ব্যুরো: হাতে আঁকা ছবি নিয়ে কোটি টাকার সোনার গহনা চুরির মামলার এক আসামি ধরার অভিযানে নেমেছে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। স্পষ্ট কোনো ছবি না পেয়ে ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে দিয়ে ছবি এঁকে ওই আসামির নাম-পরিচয় ও ঠিকানা শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। ধারণামূলক ছবি দিয়ে আসামি ধরার চেষ্টা চট্টগ্রামে এ প্রথম বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গত ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১১টার মধ্যে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর দুই নম্বর গেটের ফিনলে স্কয়ার ভবনে দুবাই প্রবাসী ফজলুল কাদেরের ফ্ল্যাটে চুরির ঘটনা ঘটে। প্রবাসীর স্ত্রী সায়লা ইয়াছমিন খুকি বাদী হয়ে দু’জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
আসামিরা হলেন- পারুল (৫৫) ও রেশমা বেগম (৩৮)। বাদীর অভিযোগ, তাদের বাসা থেকে এক কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৬০ হাজার টাকা চুরি হয়েছে।
সায়লা ইয়াছমিন খুকি সারাবাংলাকে জানান, পারুল তাদের বাসার সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী ছিলেন। ফিনলে স্কয়ারের ১৩ তলার একটি ফ্ল্যাটে বিউটি বেগম নামে এক গৃহকর্মী ছিলেন। বাসায় গৃহকর্মীর প্রয়োজন হলে সায়লা বিউটির শরণাপন্ন হয়েছিলেন। বিউটি রেশমাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। রেশমা তার খালা পরিচয় দিয়ে পারুলকে ওই বাসায় কাজ পাইয়ে দেন।
৩ ডিসেম্বর বিকেলে সায়লার বাসায় রেশমার উপস্থিতিতে পারুলের সঙ্গে কাজের আলাপ চূড়ান্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে পারুল কাজে যোগ দেন। ওই বাসাতেই সার্বক্ষণিকভাবে থাকতেন পারুল।
জানা গেছে, সায়লা দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেকে নিয়ে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন। স্বামী দুবাই এবং বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকেন। ছোট ছেলে শরিফুল কাদের তামিম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সায়লা ছেলেকে কলেজে পৌঁছে দিতে যান। ১১টার দিকে ফেরার পর দেখতে পান, বাসার দরজা খোলা এবং সেখানে পারুল নেই। বেডরুমে গিয়ে আলমারিও খোলা দেখতে পান। আরও দেখেন, আলমারিতে রাখা ১০০ ভরি সোনার গহনা এবং নগদ ৬০ হাজার টাকা নেই।
সায়লা ইয়াছমিনের ভাই ইমরানুল হক জুয়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘পারুলকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে আমরা বিউটির কাছে যাই। কিন্তু বিউটি তার কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। কারণ, বিউটি রেশমাকে চিনলেও পারুলকে চিনতেন না। আমরা ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় রেশমার বাসায় যাই। সেখানে রেশমাকেও না পেয়ে আমাদের সন্দেহ হয় যে, দুজন মিলে চুরি করেছে। ১৮ ডিসেম্বর আমার বোন দুজনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন।’
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর রাতেই আমরা অভিযান চালিয়ে রেশমাকে গ্রেফতার করি। কিন্তু রেশমাকে জিজ্ঞাসাবাদে পারুল সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। রেশমা নিজেও পারুলকে ভালোভাবে চিনে না। বাদী মামলার এজাহারে পারুল বলে যে নাম উল্লেখ করেছেন, সেটাও সঠিক কি না তিনি নিশ্চিত নন। ধারণার ওপর ভিত্তি করে দিয়েছেন। কারণ উনাদের কাছে পালিয়ে যাওয়া গৃহকর্মীর কোনো জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কপি কিংবা ছবি নেই। এজন্য আমাদের আসামি ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে।’
এনআইডি না নিয়ে অপরিচিত নারীকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘রেশমা তাকে (পারুল) খালা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আমরা এনআইডি চেয়েছিলাম। তখন রেশমা নিজের এনআইডি আমাদের কাছে জমা দিয়েছিল। ৭-৮ দিন পর পারুল নিজের এনআইডির আসল কপি এনে দেন। তখন আমরা রেশমার এনআইডি ফেরত দিই। কিন্তু আমাদের ভুল হয়েছে, আমরা পারুলের এনআইডির ফটোকপি রাখিনি বা সেটার কোনো ছবি তুলিনি। আলমারিতে এক জায়গায় এনআইডিটা রাখা ছিল। পারুল চলে যাবার সময় সেটিও নিয়ে গেছে।’
পঞ্চাশোর্ধ পারুলকে কখনোই সন্দেহজনক মনে হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বয়স্ক একজন মহিলা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আচার-আচরণ খুব ভালো ছিল। সারাক্ষণ হিজাব পড়তেন। বাইরে বের হওয়ার সময় বোরখা পড়তেন। তিনি এমন কাজ করবেন, এটা আমার বোন ভাবতেও পারেননি।’
এদিকে মামলা দায়েরের পর পালিয়ে যাওয়া গৃহকর্মীকে শনাক্ত করতে ফিনলে স্কয়ারসহ এর আশপাশের অন্তঃত ৪০টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এর মধ্যে একটি ফুটেজে সায়লা ইয়াছমিনদের বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটে ওঠার সময় পারুলের চেহারা খানিকটা দেখা যাচ্ছিল। এর বাইরে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ ছবি, নাম-ঠিকানা কিছুই নেই।
ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেশমা কোনো তথ্য দিতে পারেনি। মামলার বাদীও নাম-ঠিকানা কিছুই জানেন না। এ অবস্থায় আমাদের তো কোনো না কোনো ক্লু ধরে এগোতে হবে। কারণ, ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা প্রথমে ধারণার ওপর ভিত্তি করে তার একটি অবয়ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি।’
‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী আমাদের বিভিন্ন আঙ্গিকে কয়েকটি ছবি এঁকে দিয়েছেন। সেই ছবির মধ্য দিয়ে আমরা গৃহকর্মীকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। উন্নত দেশে এভাবে অপরাধী শনাক্তের বিষয়টি বহুল প্রচলিত। কিন্তু আমাদের এখানে এভাবে আসামি শনাক্তের চেষ্টা তেমন হয়নি।’
পুলিশ প্রাথমিকভাবে পলাতক গৃহকর্মীর বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে বলে তথ্য পেলেও সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে ওসি জানিয়েছেন।