চট্টগ্রাম-৯: একাই মাতিয়ে যাচ্ছেন নওফেল
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:৩৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সন্ধ্যা নেমেছে আরও ঘণ্টাখানেক আগে। শতাধিক নেতাকর্মীর মিছিল যাচ্ছে জামালখান থেকে কাজির দেউড়ি অভিমুখে। পেছনে আসা ট্রাকে মাইকে বাজছে, ‘শেখ হাসিনার সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন।’ মিছিলের নেতাকর্মীদের স্লোগান, ‘নওফেল ভাইয়ের সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন।’
মিছিলের মধ্যমণি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। রাস্তার দুপাশে উৎসুক মানুষ। নওফেল হাত নাড়ছেন, সালাম দিচ্ছেন, কখনো আবার মিছিল থেকে সরে গিয়ে কাউকে কাউকে জড়িয়ে ধরছেন, হাতে দিচ্ছেন লিফলেট। সবাইকে কাতর অনুরোধ নওফেলের— ‘ভোটকেন্দ্রে আসুন।’
মিছিলের আওয়াজ শুনে কাজির দেউড়ির এক ফার্নিচারের দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন তরুণ কর্মচারী। হেসে বলেন, ‘কেন যে এত কষ্ট করছেন নওফেল ভাই, উনি তো জিতেই গেছেন।’
সত্যিই চট্টগ্রাম-৯ আসনে নওফেল যেন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’! এ আসনে নওফেলের প্রতিদ্বন্দ্বী যারা, তাদের কেউ কেউ প্রচার-প্রচারণা চালালেও মাঠে সেভাবে আমেজ তৈরি করতে পারেননি।
দৃশ্যত বিজয় নিশ্চিত, তবু জোর প্রচারণায় নওফেল একাই মাতিয়ে চলেছেন, তৈরি করেছেন ভোটের আমেজ। নির্বাচনি প্রচার শুরুর পর থেকে প্রতিদিন সকালে কর্মিসভা আর দুপুরের পর মিছিল-গণসংযোগ। ঘড়ির কাঁটা দুপুর ২টার ঘরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মাইক লাগিয়ে অলিগলিতে ঘোরে একাধিক অটোরিকশা। ‘এ এলাকায় প্রার্থী যারা, নওফেল ভাই সবার সেরা, নওফেল ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’— এমন স্লোগান আর আওয়ামী লীগের নির্বাচনি গানে রাত পর্যন্ত মাতিয়ে রাখে পুরো এলাকা।
শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পরও মাঠে এত ঘাম ঝরাচ্ছেন কেন— এমন প্রশ্নে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাউকে ছোট করে দেখার শিক্ষা আমার পরিবার, আমার দল আমাকে দেয়নি। মশারির ভেতর আপনার ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য একটা মশাই যথেষ্ট। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি বা যারাই থাকুক, এবারের নির্বাচনে সারাদেশে আমাদের অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’
‘এ অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মূল হোতা লন্ডনে বসে থাকা তারেক রহমান। যদিও তারা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে এবং ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর চূড়ান্তভাবে দুর্বল হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি, তবুও এখনো সেই শক্তিকে মোকাবিলার লড়াইটা একেবারে সহজ নয়। সুতরাং এ নির্বাচনে আমাদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী,’— বলেন নওফেল।
১৬১ বর্গকিলোমিটারের চট্টগ্রাম শহরের ‘জিরো পয়েন্ট’ ধরা হয় নিউমার্কেটকে। ব্যস্ততম এ এলাকাকে ঘিরে ১৪টি ওয়ার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম-৯ সংসদীয় আসন। কোতোয়ালি, বাকলিয়া ও চকবাজার থানার বাসিন্দাদের মধ্যে চার লাখ ৯ হাজার ৫৮৭ জন এ আসনের ভোটার। এর মধ্যে দুলাখেরও বেশি ভোটার বাকলিয়ার।
দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে মর্যাদার আসন হিসেবে পরিচিত এ এলাকা থেকে যিনি সংসদ নির্বাচনে জিতেছেন, তার দলই সরকার গঠন করেছে।
চট্টগ্রাম-৯ আসনে এবার মোট প্রার্থী সাতজন। নৌকার নওফেল ছাড়া বাকিরা হলেন— জাতীয় পার্টির সানজিদ রশিদ চৌধুরী, ন্যাপের মিটুল দাশগুপ্ত, ইসলামিক ফ্রন্টের মো. ওয়াহেদ মুরাদ, ইসলামী ফ্রন্টের আবু আজম, কল্যাণ পার্টির মুহাম্মদ নূরুল হোসাইন ও তৃণমূল বিএনপির সুজিত সাহা। এদের মধ্যে কল্যাণ পার্টি ও তৃণমূল বিএনপির প্রচারণা নেই বললেই চলে।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী সানজিদ রশিদ চৌধুরীর পারিবারিক পরিচিতি আছে। লাঙ্গলের ব্যারিস্টার সানজিদকে নৌকার নওফেলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবা হচ্ছে ভোটের মাঠে। তার বাবা প্রয়াত এ বি এম ফজলে রশিদ চৌধুরী এবং মা প্রয়াত ড. মাসুদা রশিদ চৌধুরী। ফজলে রশিদ চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বড় ভাই। মাসুদা রশিদ চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ষাটের দশকের ছাত্রনেতা এবং এরশাদের আমলের সংসদ সদস্য। উভয়ই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য।
সানজিদের দাদা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। কোতোয়ালির পাথরঘাটায় দাদার বাড়ি, এনায়েত বাজারে নানার বাড়ি। সানজিদের দাবি, এনায়েত বাজারে যে বাড়িতে তিনি থাকেন, তার সেই নানার বাড়ির বয়স ১৪২ বছর এবং পাথরঘাটায় তার দাদার বাড়ির বয়স ১০০ বছর। সুতরাং রাউজানে তাদের মূল নিবাস হলেও বংশ পরম্পরায় তারা চট্টগ্রাম-৯ আসনেরও ভূমিপুত্র।
ভোটের মাঠে নতুন সানজিদের পোস্টার-ব্যানার লেগেছে সড়কে, অলিগলিতে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগও করছেন তিনি। জানালেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও অনেক কর্মী-সমর্থক ভোটের মাঠে তার সঙ্গে আছেন। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরাও দলাদলির ঊর্ধে উঠে তার জন্য কাজ করছেন।
সানজিদ রশিদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছেন। সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে। সেজন্য আমি নির্বাচনে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর ওপর আমার অবিচল আস্থা আছে। এরপরও যদি দেখি নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, তাহলে সরে যাব।’
গণসংযোগে কেমন সাড়া পাচ্ছেন— জানতে চাইলে সানজিদ বলেন, ‘সবাইকে একটাই কথা বলছি— মার্কা দেখে নয়, ব্যক্তি দেখে ভোট দিন। আমার পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষাদীক্ষা এসব একবার বিবেচনা করুন। এই যে চট্টগ্রামে শহিদ মিনার, মুসলিম ইনস্টিটিউট হল— এগুলো আমার মা যখন এমপি ছিলেন, তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে করেছিলেন। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা। আমি কারও বিরুদ্ধে বলব না। শুধু বলব, বঙ্গবন্ধুর নৌকা আর আজকের নৌকা এক নয়। আমি ভালোই সাড়া পাচ্ছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ফলাফল আপনারা দেখবেন।’
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফফর) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। চট্টগ্রামে একসময় দলটির ‘ভরা যৌবন’ ছিল, এখন ভাটার টান। কুঁড়েঘর প্রতীকে এ আসনে প্রার্থী হয়েছেন মিটুল দাশগুপ্ত। তিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা। চট্টগ্রামে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থাকেন। এ জন্য তার আলাদা পরিচিতি আছে। ১৪ দলের নেতা হিসেবেও তিনি পরিচিত।
এর মধ্যে গত ১৯ ডিসেম্বর মিটুল এক ‘কাণ্ড’ ঘটান। ওই দিন দুপুরে নগরীর জামালখানে সিনিয়রস ক্লাবে নৌকার প্রার্থী নওফেলের মতবিনিময় সভা ছিল। মিটুলও গিয়ে সেই সভায় দর্শকসারিতে বসেন। তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি শুধু কাগজে-কলমে— এমন আলোচনা তৈরি হয় খোদ সভার মধ্যে। জবাব দেন মিটুল-নওফেল দুজনই।
নওফেল বলেন, ‘ন্যাপ আমাদের ১৪ দলীয় জোটের অংশ হলেও সারাদেশে বিভিন্ন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে।’
আর মিটুল বলেন, ‘নির্বাচন নির্বাচনের জায়গায়। আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা সৌহার্দ্যের। এ সম্পর্ক উনার বাবা বেঁচে থাকার সময়ও অপরাপর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাখতেন। নির্বাচনের মাঠে তো উনার সঙ্গে নওফেল সাহেবের সঙ্গে অবশ্যই আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’
তবে নওফেলের মতবিনিময় সভা থেকেই বেরিয়েই মিটুল হ্যান্ডমাইক নিয়ে বেরিয়ে যান প্রচারে। এভাবে প্রতিদিন জনাকয়েক কর্মী নিয়ে বাজারে, অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে লিফলেট বিলি করছেন আর হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দিয়ে কুঁড়েঘর প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন।
গুটিকয়েক কর্মী নিয়ে কীভাবে নৌকার প্রার্থীকে পরাস্ত করবেন— জানতে চাইলে মিটুল দাশগুপ্ত বলেন, ‘মানুষের নিয়ম হচ্ছে, তারা স্রোতের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। আমার দল ক্ষমতাসীন দল নয়। আমরা জোটে আছি, কিন্তু ক্ষমতায় নেই। বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক সাংবিধানিক ব্যবস্থার কারণে একজন ব্যক্তি যখন সংসদ সদস্য হন এবং এরপর যখন আবার মন্ত্রীও থাকেন, তখন তার পেছনে মানুষের অভাব হয় না। আমি কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি এমন প্রার্থীর সঙ্গে যিনি এমপিও, আবার মন্ত্রীও।’
‘আজ হয়তো আমার গলার আওয়াজ ছোট, কিন্তু একসময় আমার দল ন্যাপ বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ছিল। আমাদের প্রতীক কুঁড়েঘর দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। আমার অর্থবিত্ত নেই, ক্ষমতা নেই কিন্তু সততা আর মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট আছে। সেটা নিয়েই মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে যাচ্ছি। মানুষ যথেষ্ট সাড়া দিচ্ছে। আশা করছি, কুঁড়েঘর প্রতীককে মানুষ জয়ী করবে,’— বলেন মিটুল দাশগুপ্ত।
ইসলামিক ফ্রন্টের মো. ওয়াহেদ মুরাদ বাকলিয়ার বাসিন্দা, যে এলাকায় দেশের বিভিন্ন জেলার নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। ওয়াহেদ মুরাদ স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রয়াত কফিল উদ্দিনের সন্তান। গণসংযোগে চেয়ার প্রতীকের ওয়াহেদ মুরাদ বাকলিয়া, দেওয়ানবাজার, চন্দনপুরা, চকবাজার এলাকাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।
ইসলামী ফ্রন্টের মোমবাতি প্রতীকের আবু আজমও জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন এ প্রার্থী।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাবা প্রয়াত রাজনীতিক এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯১ সালে এ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। বিএনপির আবদুল্লাহ আল নোমানের কাছে তিনি অল্প ভোটে হেরেছিলেন। ২৮ বছর পর ২০১৮ সালে নওফেল বিএনপির শাহাদাত হোসেনের মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তরুণ এ সংসদ সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে নওফেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে অচিরেই দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উত্থান হবে। আগামী নির্বাচনে আমরা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিপক্ষ দলের মোকাবিলা করবে।’
‘এ নির্বাচন অবশ্যই এমন একটি সুযোগ ও প্রত্যাশা তৈরি করেছে। বিএনপির ভেতরেও যারা প্রগতিশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নেতাকর্মী আছেন, তারাও এ সুযোগটা নিতে পারেন। আমাদের সবার প্রত্যাশা, এ দেশে সরকারি দলও হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর বিরোধী দলও হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
চট্টগ্রাম-৯ জাতীয়-নির্বাচন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মিটল দাশগুপ্ত মো. ওয়াহেদ মুরাদ সংসদ নির্বাচন সানজিদ রশিদ চৌধুরী