প্রক্টর রানার ছুটিবিহীন পিএইচডি, উপাচার্যের নির্দেশে নথিভুক্ত
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:২১
কুমিল্লা: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর (রানা) পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্তকরণ নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি সুপারিশ না করলেও উপাচার্য অধ্যাপক ড এ এফ এম আবদুল মঈনের নির্দেশে তা নথিভুক্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ ডিসেম্বর (রোববার) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো: আমিরুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস স্মারকে ডিগ্রির সনদ নথিভুক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়ায় ওমর সিদ্দিকী রানার পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্ত করা হয়। এর আগে, একইরকম সিনিয়র অধ্যাপকদের ডিঙিয়ে এই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কুবি উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈন। এদিকে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ভেঙে পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্ত করার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী বলেন, ‘এটি ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া নয়। এ ধরণের স্বজনপ্রীতিমূলক সিদ্ধান্তে উচ্চশিক্ষার কাঠামো এবং মান দুটোই সংকটের মুখে পড়বে।’
জানা গেছে, মূলত ডিগ্রি অর্জনের জন্য শিক্ষা ছুটিতে বিদেশ গেলে কাজী ওমর সিদ্দিকীর (রানা) ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরশিপে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতো বিধায় তিনি শিক্ষা ছুটির পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে ২২ দিন, ২৮ দিন ও ২১ দিন অর্জিত ছুটি গ্রহণ করে ডিগ্রি অর্জনের কাজে মালেশিয়ায় অবস্থান করেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, কাজী ওমর সিদ্দিকী পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য প্রাথমিকভাবে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেন। ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি এ আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট ওমর সিদ্দিকী করোনা মহামারির সময়ে ইউনিভার্সিটি অব পুত্রা মালয়েশিয়ার (UPM) এর পুত্রা বিজনেস স্কুল (পিবিএস) এ অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রমের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। যা ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র করোনা চলাকালীন অনলাইন ক্লাসের অনুমোদন দেয়। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব শেষ হওয়ার পরও তিনি অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে এ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
এদিকে পিএইচডি চলাকালীন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রমে অংশ নেন। শিক্ষা ছুটি গ্রহণ না করলেও তিনি ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ১৫ মে, ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে এবং একই বছরের ১৩ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে ২২ দিন, ২৮ দিন ও ২১ দিন মালেয়েশিয়ায় অবস্থান করেন। তবে সিন্ডিকেটে উল্লেখিত ২ বছর ছুটি তিনি পূর্ণ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬ তম সিন্ডিকেট সভার ৪৫ আলোচ্যসূচির সিদ্ধান্তে বলা হয়, যে সব শিক্ষক উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মনোনীত হয়েছেন। কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে ভিসা সংগ্রহে বিলম্ব হচ্ছে সে সব শিক্ষক ভর্তিকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন। তবে অনলাইন ক্লাস শুরুর দিন থেকেই শিক্ষা ছুটি নীতিমালা অনুযায়ী ছুটি নিতে হবে।
এ ছাড়াও সিন্ডিকেটের ৮৬ তম সভার ৩২ আলোচ্যসূচির সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘যে সকল শিক্ষক করোনাকালীন সময়ে উচ্চ শিক্ষার্থে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি প্রাপ্ত হয়েছেন তাদেরকে কমপক্ষে দুই বছর সরাসরি উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তাদের অর্জিত ডিগ্রি (পিএইচডি) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্য হবে না।’ পরে এই সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার জন্য তিনি আবেদন করেন।
তবে প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ডিকেটর ৮৭ তম সভায় আরেকটি সিদ্ধান্ত জানানো হয় যে, শুধুমাত্র করোনা মহামারির সময়ে অনলাইনে পিএইচডি শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত যে সব শিক্ষকের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হতে দুই বছরের কম সময় লাগবে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম কোন পর্যায়ে আছে এবং তা শেষ করার সময়সীমা সম্পর্কে সুপারভাইজার থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে পিএইচডি কার্যক্রমের অবশিষ্ট অংশ সরাসরি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তবেই এটি রেগুলার ডিগ্রি হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রেও ওমর সিদ্দিকী তার অর্জিত ডিগ্রির মূলকপি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেননি বলে যাচাই-বাচাই কমিটির সুপারিশে জানানো হয়।
এ বিষয়ে কাজী ওমর সিদ্দিকী জানান, ‘আমি নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি চিঠি প্রদান করেছি। সব কিছু রেজিস্ট্রার অফিসে জমা দিয়েছি। কোনো কিছু জানতে চাইলে সে জায়গা থেকে সংগ্রহ করুন।’
তবে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যাচাই-বাছাই একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়ায় ডিগ্রির সনদ সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। তবে করোনাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকে শিক্ষক শিক্ষাছুটি গ্রহণ করেননি। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে এটি কি অনলাইন নাকি রেগুলার! যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে আমরা আমাদের মতামত জানিয়েছি। কাজেই এটি গ্রহণ করা এবং না করার বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রশাসনের এখতিয়ার। উপাচার্য মহোদয় নিজ এখতিয়ারে এটিকে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
সনদ নথিভুক্তকরণ কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কোন প্রক্রিয়ায় ডিগ্রি নথিভুক্ত করা হয়েছে তা উপাচার্য বলতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান মোতাবেক আমাদের যে দায়িত্ব ছিল, আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি। এখানে সিন্ডিকেটের ৭৬তম ও ৮৬তম সভার কোন সিদ্ধান্ত প্রতিপালন না করায় কমিটি সুপারিশ করেছে, তার ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কমিটির সিদ্ধান্ত গৃহীত না করে উপাচার্য নিজের মতো করে নির্দেশনা দিয়েছেন। কোন প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করেছেন সেটা তিনি বলতে পারবেন।’
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কথা বলতে হলে তোমাকে আমার অফিসে আসতে হবে।’ কিন্ত প্রতিবেদক অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করার কথা জানালে তিনি বলেন, ‘আমি তোমার এসব নিউজের বক্তব্য দেওয়ার জন্য বসে নেই। আমার অনেক কাজ আছে। পরে তিনি প্রতিবেদকের কল কেটে দেন।’
তবে শিক্ষা ছুটি গ্রহণ না করে ডিগ্রি সম্পন্ন করার এই প্রক্রিয়ায় উচ্চশিক্ষার মান কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিউট ( আইইআর) বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান জানান, গবেষণা সবসময় ইথিক্যালি হয়, পার্টটাইম নয়। কোনো শিক্ষক যদি দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করেন তাহলে অবশ্যই তাকে শিক্ষাছুটি গ্রহণ করতে হবে। পিএইচডির ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা রয়েছে, তাকে নির্দিষ্ট দিনের ছুটি নিতে হবে, এজন্য তিনি অর্থও পাবেন।
তিনি আরও বলেন, ‘পিএইচডি হলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান লাভ করা, ছুটি না নিয়ে এভাবে পিএইচডি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তিনি অন্য কোন উপায়ে পিএইচডি করেছে কিনা এটিও দেখা দরকার। পিএইচডিতে সুপারভাইজারের কাছে রেগুলার ফিডব্যাক দিতে হয়। গবেষণায় শিক্ষার বিষয় থাকে, নির্দেশনার বিষয় থাকে। মালয়েশিয়ার কোন মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালযয়ের ক্ষেত্রে এটি সম্ভব নয়। আমার মনে হয় ওই শিক্ষকের থিসিসটা দেখা দরকার কোন উপায়ে তিনি এটি করেছেন। কেননা শিক্ষাছুটি না নিয়ে দেশে থেকে এত অল্প সময়ে বাইরের দেশ থেকে পিএইচডি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
সারাবাংলা/একে