বাদশার সঙ্গে নেই আ.লীগ, স্বতন্ত্রের চ্যালেঞ্জের মুখে নৌকা
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০২
রাজশাহী: রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি ১৪ দলের প্রার্থী হয়ে টানা তিন বার এই আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে প্রার্থী না থাকায় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে মিনুর সাথে ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন তিনি। কিন্তু এবার আর ছাড়তে চাচ্ছেন না অন্য প্রার্থীরা। ১৪ দলের নেতৃত্বাধীন জাসদের প্রার্থীও আছেন এই আসনে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী, জাতীয় পার্টি, বিএনএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থীরাও আছেন।
ফজলে হোসেন বাদশা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ভোট করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এবার ফজলে হোসেন বাদশা পাশে পাচ্ছেন না আওয়ামী লীগসহ জোটের অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের। এবার অনেকটা তিনি ‘একা’ হয়ে গেছেন। নিজ দলের কর্মী ও সমর্থক নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।
সদর আসনটিতে ফজলে হোসেন বাদশার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা। এছাড়াও শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছেন জাসদের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী। এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী পার্টির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুল ইসলাম স্বপন, বিএনএম প্রার্থী কামরুল হাসান, বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী মারুফ শাহরিয়ার ও মুক্তিজোটের প্রার্থী ইয়াসির আলিফ বিন হাবিব। এই আসনে মূলত তিন প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। পুরো নির্বাচনে প্রচারে এগিয়ে আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচি, ১৪ দলের প্রার্থীর নৌকা ও জাসদের মশাল প্রতীক।
এই নির্বাচনে আটঘাট বেঁধে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জেতাতে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, ফজলে হোসেন বাদশা টানা তিন বারের এমপি হয়েও জোটের কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। তিনি কোনো খোঁজখবরও রাখেননি। তিনি আমাদের কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মন্তব্যও করেছেন। তাই এবার তার পক্ষে কাজ করছে না কেউ।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম উল আজিম নিযামের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল ফজলে হোসেন বাদশার। কাউন্সিলর নিযাম ফজলে হোসেন বাদশাকে ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। ফজলে হোসেন বাদশার দূর সম্পর্কের আত্মীয় তিনি। ২০১৮ সালে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম ফজলে হোসেন বাদশার পক্ষে কাজ করেছিলেন। দুটি বিশাল শোডাউনও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার তিনি পাশে নেই।
কাউন্সিলর নিযাম উল আজিম নিযাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার আমরা পরিবর্তন চাই। তাই কাঁচি প্রতীকের পক্ষ নিয়েছি। বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে এক সময়ে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। সর্ম্পক সবসময় একরকম থাকে না, পরিবর্তনও হয়। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে কারও পক্ষে কাজ করা যাবে। তাই আমরা কাঁচি প্রতীকের পক্ষে আছি।’
রাজশাহীতে মূলত ১৪ দলের মধ্যে পাঁচটি দলের কার্যক্রম বর্তমান। এর মধ্যে নয়টি দলই নেই। আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ বাদে আছে দিলীপ বড়ুয়ায় সাম্যবাদী দল ও মোজাফ্ফর আহমেদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তবে সাম্যবাদী দল ও ন্যাপের শুধু কমিটিই আছে। তাদের কার্যক্রম নেই। তবে এই দুটি দলের নেতারাও জোট প্রার্থীর সঙ্গে নেই।
ন্যাপের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম এবার সমর্থন দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশাকে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রাজশাহী-২ আসনে পরিবর্তন দরকার। শফিকুর রহমান বাদশার যোগাযোগও অনেক ভালো। তাকে সবসময় পাশে পাওয়া যাবে। এছাড়াও তিনি আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। আমরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলাম। তাই আমি তাকে এবার সমর্থন দিয়েছি। কারণ, এবার কোনো বাধা দেখছি না।’
এদিকে, জাসদ নেতারা বলছেন, ফজলে হোসেন বাদশা এমপি থাকা অবস্থায় বিছিন্ন হয়ে গেছেন। এবার তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশার সঙ্গে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও মহানগরের সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের ভোট টানতে মাঠে কাজ করছেন তারা। তবে দলটির ধারণা, জাসদ এই নির্বাচনে ভালো অবস্থানে আছে। মাঠ পর্যায়ে ভালো সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।
জাসদের মহানগর সহসভাপতি শাহরিয়ার রহমান সন্দেশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রচারের শুরু থেকে আমরা ভালো সর্মথন পাচ্ছি। মানুষজনও পরিবর্তন চাচ্ছে। আমরাও ভোটে লড়াই করতে চাচ্ছি। এখানে চার জন প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা হতে পারে। আমরা কোনো দলকে ছোট করে দেখতে চাচ্ছি না। সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে মেনে নিচ্ছে।’
এদিকে, ভোটের মাঠে লড়ছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সাইফুল ইসলাম স্বপন। তিনি এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হন। এবার তিনি জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমার সফট কর্নার ছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন আমার ভাতিজা হয়। সেজন্য আমারও জেতার ইচ্ছা ছিল না। তবে এবার আমি মাঠ ছাড়ব না। জয়ী হয়ে আসব।’
এই আসনের আরেক প্রার্থী কামরুল হাসান। তিনি বিএনএম থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রচার চালাচ্ছি, মানুষজনও সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তারা কত ভোট দেবে তা দেখার বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই আসনে নৌকা ও কাঁচি নিয়ে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যা নিরসন না হলে আমার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
জাসদ প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহানগরীর মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছে। আমরাও পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রচার চালাচ্ছি। ভোটাররা আমাকে সমর্থন দিচ্ছে। অন্য প্রার্থীরাও প্রচার চালাচ্ছেন। তবে আমার প্রচারে ভিন্নতা এনেছি। আমাদের টার্গেট তরুণ ভোটার। তরুণরা আমাদের ভোট দিলে জয়ী হব।’
এদিকে, নৌকাকে সমর্থন না করলে আওয়ামী লীগ আত্মহননের পথে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির মহানগর সভাপতি লিয়াকত আলী লিকু। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ফজলে হোসেন বাদশাকে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন ১৪ দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখানকার নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। ওই প্রার্থীকে জেতানো হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মহনন। ফজলে হোসেন বাদশাকে হারানো মানে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করা। নৌকাকে হারানো মানে স্বাধীনতাকে পরাজিত করা। এতে শেখ হাসিনাও হারবে। ফজলে হোসেন বাদশা একা হারবে না। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করছেন তারা কেউই আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ করছেন না।’
অপরদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘যিনি এমপি আছেন তিনি জনবিচ্ছিন। জোট বাদে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আর এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই তাই প্রার্থী হয়েছি। আমার নিজস্ব কিছু কর্মী আছে। তারা আমাকে সহযোগিতা করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে কেন্দ্র নমনীয়। তিনি টানা তিনবারের এমপি থেকেও নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষদের মূল্যায়ন করেননি। তাই এবারের নির্বাচনে আমি বিপুল ভোটে জয়ী হব।’
তবে টানা তিন বারের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা কোনো ‘চ্যালেঞ্জ’ দেখছেন না। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যত উন্নয়ন সব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের আমলে। আর জোটগত সিদ্ধান্ত হওয়ায় নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছি। আমাকে প্রধানমন্ত্রী নিজে এই প্রতীক দিয়েছেন। মানুষ অচেনা কোনো প্রতীকে ভোট দেবে না। নৌকা উন্নয়নের প্রতীক। জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দেবে।’
উল্লেখ্য, রাজশাহী-২ (সদর) আসনটি সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এই আসনে মোট ভোটার আছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৩। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ৪১৩, নারী ভোটার ১ লাখ ৮১ হাজার ৩৬৪। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন তিন জন।
সারাবাংলা/পিটিএম
আওয়ামী লীগ ফজলে হোসেন বাদশা শফিকুর রহমান বাদশা সাইফুল ইসলাম স্বপন স্বতন্ত্র