Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বড় আশায় বছর শুরু, হতাশায় শেষ

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৬

ঢাকা: বিএনপির জন্য বিদায়ী বছর শুরু হয়েছিল আগের বছরে ঘোষিত ১০ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বছর প্রথম দিন ১ জানুয়ারি দলের সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নয়াপল্টনে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘বিদেশে টাকা পাচারের কারণে অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সরকারি দলের লোকজনের সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, বিচার বিভাগের দলীয়করণের কারণে মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যে ১০ দফা ঘোষণা করেছি, সেই ১০ দফা বাস্তবায়ন-ই নতুন বছরে বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

বিজ্ঞাপন

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এখন গুরুতর অসুস্থ। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন। আর বিএনপির সেই ১০ দফা এখন এক দফায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কোনো দফার সঙ্গেই নেই। শারীরিক সুস্থতা এখন তার একমাত্র চাওয়া। দুই দিন আগে পরিবারের পক্ষ থেকে তার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে।

বিএনপির প্রবীণ এই নেতার শারীরিক অবস্থা যেন দলের সার্বিক অবস্থার প্রতীকী চিত্র। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনে আছে। কিন্তু থেমে নেই নির্বাচনি ট্রেন। সেটি ছুটছে আপন গতিতে নিজ গন্তব্যে। ফলে বিদায়ী বছরটাও সরকার হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নভঙের বছর হয়েই থাকল বিএনপির জন্য।

অথচ বিদায়ী বছরটাতেই ক্ষমতারোহনের স্বপ্ন পূরণে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিল বিএনপি। এর পেছনে ছিল আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী অনেক দেশ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থকরা। বিশেষ করে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের দৌড়াদৌড়িতে অতি মাত্রায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন বিএনপি নেতারা। সরকার পতনে দিনক্ষণ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছিলেন তারা। আপাতত সব কিছু থমকে গেছে। থেমে গেছে বিদেশিদের তৎপরতাও। দলটির নেতাকর্মীরা এখন বলছেন, ‘ভাগ্যে ছিল, কপালে নেই!’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

বিদায়ী বছরে কয়েকটি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগের শেষ ছিল না দলটির। কারণ তার শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিল বিএনপি। বিগত দিনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে এগোলে দলটির উদ্বেগ বেড়ে যায়। নির্বাচন ঘিরে দলের সম্ভাব্য ভাঙন নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিল বিএনপি। অবশ্য দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ছাড়া বড় কোনো নেতা শেষ পর্যন্ত দল ছাড়েননি। যদিও দীর্ঘদিন পদহীন এবং দলে গুরুত্বহীন সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম, বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালে খালেদা জিয়া, কারাগারে ফখরুল

বিদায়ী বছরটা ছিল বিএনপির জন্য ‘কিছু করে দেখানো’র বছর। কিন্তু সেই ‘করে দেখানো’র জন্য যে জোরাল নেতৃত্ব প্রয়োজন, তার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দলটি। বছরজুড়েই দলের চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কখনো কেবিনে, কখনো আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা চলছে তার। ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় এসে ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার অস্ত্রোপচার করেন। বছরের শেষ দিকে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতির খবর পাওয়া যায়। তবে এই মুহূর্তে বাসায় ফিরতে পারছেন না তিনি। থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে।

গ্রেফতারের পর মির্জা ফখরুলকে আদালতে নেওয়া হয়। সারাবাংলা ফাইল ছবি

দলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বছরটাই শুরু হয়েছিল কারাবাসের মধ্য দিয়ে। আগের বছর ৮ ডিসেম্বর গ্রেফতার হওয়ার পর বিদায়ী বছরের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। এর আট মাস ২০ দিন পর গত ২৯ অক্টোবর আবারও গ্রেফতার হন মির্জা ফখরুল। বছরের শেষ দিনটাতেও তিনি কারাগারেই বন্দি।

নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ, তারপর আত্মগোপন

গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের দিন পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও পুলিশ হাসপাতালে ভাঙচুর ঘটনার পর ২৯ অক্টোবর থেকে চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। কিন্তু এসব কর্মসূচি সফল করার জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি।

মূলত মহাসমাবেশের পরপরই দলটির শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। গ্রেফতার হন বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। দলটির দফতর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ৫৯৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটির ৯১ জন কর্মকর্তা কারাগারে। বাকি ৫০৫ জন লাপাত্তা। মাঠে আছেন কেবল রুহুল কবির রিজভী।

২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করে বিএনপি। সারাবাংলা ফাইল ছবি

১২ শ নেতাকর্মীর সাজা

বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, গত ২৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশে মোট গ্রেফতার হয়েছেন ২৬ হাজার ৭৫১ জন নেতাকর্মী। এই সময়ে মামলা হয়েছে এক হাজার ৯৪টির বেশি। মোট আসামি হয়েছেন ৯৮ হাজার ২৩১ জন, আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৩৯ জনের বেশি নেতাকর্মী। আর মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের।

এ ছাড়া ৮১টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও এক হাজার ২৬৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বিএনপির। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) নাশকতার দায়ে রাজধানীর গুলশান থানার মামলার রায়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন ও মেজর (অব.) হানিফকে ২১ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এক দফার আন্দোলন ‘ফ্লপ’

১০ দফার আন্দোলন টানা ছয় মাস টেনে নিয়ে বিদায়ী বছরের ১২ জুলাই এক দফায় নামিয়ে আনে বিএনপি। ওই দিন রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষণা হয় সরকার পতনের এক দফার আন্দোলন।


দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগই কারাগারে বা আত্মগোপনে থাকলেও রুহুল কবির রিজভী নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। সারাবাংলা ফাইল ছবি

এক দফার ঘোষণায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেদিন বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করার লক্ষ্যে এই এক দফা।’

কিন্তু বিএনপির এই এক দফার আন্দোলনও ফ্লপ। নির্বাচন ঠেকিয়ে দেওয়ার যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য এক দফার আন্দোলন শুরু করেছিল দলটি, সেটি সফল হয়নি। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। দৈব কিছু না ঘটলে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হয়ে যাবে— এ বিশ্বাস এখন খোদ বিএনপি নেতাদেরও।

শেষ চেষ্টা হিসেবে ‘অসহযোগ’-এর ডাক

২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ‘পণ্ড মঞ্চ’ থেকে কর্মীদের পীড়াপীড়িতে হরতালের ডাক দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২৯ অক্টোবর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের পর দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এ পর্যন্ত ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করেছে দলটি। কিন্তু বিএনপির এই হরতাল-অবরোধ সরকারকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি। তার ওপর হরতাল-অবরোধের দিনগুলোতেও রাজধানী ঢাকায় যানজট রীতিমতো মাত্রা ছাড়াতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে কর্মসূচির ধরন পরিবর্তন করে বিএনপি। নেতাকর্মীদের মাঠে ফেরাতে মানবন্ধন, গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতে ফিরে যায় তারা।

এরপর গত ২০ ডিসেম্বর ‘সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন’-এর ডাক দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনি দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। সরকারকে কর, খাজনা ও বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল পরিশোধ বন্ধ করে দেওয়া এবং ব্যাংকে আমানত না রাখার আহ্বান জানানো হয়। মামলার আসামি দলীয় নেতাকর্মীদেরকে আদালতে হাজিরা না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ‘অসহযোগ’-এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি রাজনীতিতে।

শেষ মুহূর্তে এসে নৌকা প্রতীকে ভোট করার ঘোষণা দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। সারাবাংলা ফাইল ছবি

দলে নির্বাচনের ঝাঁকুনি!

দলীয়ভাবে নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপির অন্তত ৪০ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন। কোনো এক জায়গায় হিসাব-নিকাশে ‘গরমিল’ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে যাননি। তবে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি ঠিকই লেগেছে বিএনপিতে। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে এম ইকরামুজ্জামান, নির্বাহী সদস্য শাহ মো. আবু জাফর, সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লাসহ অন্তত ৩৪ জন নেতা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় না থাকলেও নিজ নিজ এলাকায় বিএনপির রাজনীতিতে প্রভাবশালী।

দীর্ঘদিনের আন্দোলন সঙ্গী, রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকও শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে নির্বাচনে গেছেন। অ্যাডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী ও মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুসলিম লীগও (বিএমএল, নিবন্ধন নম্বর ৪০, প্রতীক পাঞ্জা) বিএনপি জোট ছেড়ে ভোটে অংশ নিয়েছেন।

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

১০ দফা অবরোধ-হরতাল অসহযোগ এক দফা খালেদা জিয়া হাসপাতালে নির্বাচন বিএনপি মির্জা ফখরুল গ্রেফতার রুহুল কবির রিজভী সরকার পতনের আন্দোলন

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর