ভোটের বাকি এক সপ্তাহ, তবু উত্তাপ নেই নড়াইলে
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৫৮
নড়াইল থেকে: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে আর মাত্র এক সপ্তাহ। শেষ এই সময়ে অনেক এলাকাতেই জমে উঠেছে নির্বাচনি প্রচারণা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আর সমর্থকদের নিয়ে চলছে জমজমাট প্রচার। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নড়াইলের দুটি আসনে অনেকটাই নিরুত্তাপ ভোটের মাঠ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভোটের মাঠের চিরাচরিত মিটিং-মিছিল নেই বললেই চলে। নির্বাচনের প্রার্থীরা যখন কোনো এলাকায় প্রচারে যাচ্ছেন, সেখানেই কেবল কিছুটা ভোটের আমেজ ছড়াচ্ছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলে জেলাটি ব্যাপকভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। একাদশের মতো দ্বাদশেও নড়াইল-২ আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন মাশরাফি। আর নড়াইল-১ আসনে টানা তৃতীয়বারের মতো নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি। নৌকার প্রতিপক্ষ হিসেবে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দুটি আসনেই ভোটের প্রচারে এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে আওয়ামী লীগ।
দেশের অন্যান্য অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত অনেক নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও নড়াইলের চিত্রটি ভিন্ন। নড়াইল-১ আসনে থেকে বর্তমান এমপি কবিরুল হক মুক্তির স্ত্রী চন্দনা হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে ১৯ ডিসেম্বর তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহারও করে নেন। এর বাইরে কবিরুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ওয়ার্কার্স পার্টির মো. নজরুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির মো. মিল্টন মোল্যা, তৃণমূল বিএনপির শ্যামল চৌধুরী ও জাতীয় পার্টি-জেপির শামিম আরা পারভীন (ইয়াসমিন)। তবে তাদের কেউই মুক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শক্তিশালী নন বলেই মনে করেন মুক্তির অনুসারীসহ ভোটাররাও।
এদিকে নড়াইল-২ আসনে মাশরাফির প্রতিদ্বন্দ্বী ছয়জন। তাদের মধ্যে আছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. মনিরুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির খন্দকার ফায়েকুজ্জামান, গণফ্রন্টের মো. লতিফুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের মো. মাহবুবুর রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল আমির লিটু। এর মধ্যে দলীয় প্রার্থীদের কাউকেই মাশরাফির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন না ভোটাররা। সেদিক থেকে লিটু কিছুটা হলেও হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারবেন। তবে মনোনয়নপত্র বাতিলের পর ইসিতে ব্যর্থ হয়ে উচ্চ আদালত থেকে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন গত ২৮ ডিসেম্বর। ২৯ ডিসেম্বর থেকে ভোটের মাঠে নামতে পারায় প্রচারে কিছুটা পিছিয়ে গেছেন লোহাগড়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের দুইবারের এই সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
অসুস্থতার কারণে মাশরাফি নিজেও অবশ্য ভোটের প্রচার শুরু করেছেন ২৪ ডিসেম্বর। লিটু প্রার্থিতা ফিরে পেলেও নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস খুব একটা দেখছেন না ভোটাররা। নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থনও এখন পর্যন্ত মাশরাফিই পাচ্ছেন বলে তথ্য মিলছে।
শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা থেকে নড়াইল শহরে ঢিলেঢালা নির্বাচনি প্রচার চোখে পড়ে। বর্তমান সংসদ সদস্য মাশরাফি শুক্র ও শনিবার দুই দিনই লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অন্যদিকে শনিবার সকাল থেকেই লোহাগড়ার বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ শুরু করেছেন ট্রাক প্রতীকের লিটু। শনিবার সকালে নড়াইলেও প্রচার চালিয়েছেন তিনি।
নড়াইলের দুই আসনেই প্রচারে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রচারে এগিয়ে রয়েছেন। ভোটের মাঠে বাকিদের উপস্থিতি অনেকটা রুটিন প্রচারের মতোই। পোস্টার ছাপিয়ে, লিফলেট বিলি করে ও স্বল্পমাত্রায় মাইকিং করে প্রচার চালাচ্ছেন তারা। নৌকার প্রার্থীরা উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছেন, আর বাকিরা বলছেন নড়াইল নিয়ে তাদের স্বপ্নের কথা।
নড়াইল সদরের বাসিন্দা মাশরাফির শহরে বেশ কয়েকটি নির্বাচনি প্রচার কেন্দ্র দেখা গেল। এসব প্রচারকেন্দ্রে সন্ধ্যার পর কোনো লোক দেখা যায়নি। ঢিলেঢালাভাবে চলছে ভোটের লিফলেট বিতরণের কাজ। সব মিলিয়ে নড়াইল সদরে ভোটের চিত্র অনেকটাই ম্যাড়মেড়ে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা থাকলেও সাধারণ মানুষ নিরুত্তাপ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নৌকার প্রার্থী জিতবে— এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে কোনো উত্তেজনা অনুভব করছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভোটার বলেন, ‘কীসের আর ভোট, মাশরাফিই তো জিতবে!’
শীতের বিকেলে-সন্ধ্যায় নড়াইল চৌরাস্তার চায়ের দোকানগুলোতে চায়ের কাপে উত্তাপ খুঁজছিলেন অনেকেই। কয়েক দোকান ঘুরে ঘুরে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় নির্বাচনের কোনো আমেজ নাই। নাই মিছিল-মিটিং বা অন্যান্য প্রচার।
সাধারণ মানুষ যাই বলুক, ম্যাড়মেড়ে নির্বাচনের বিষয়টি স্বীকার করছেন না নির্বাচনের প্রার্থী ও রাজনীতিবিদরা। নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দিনরাত প্রচার চালাচ্ছি। জনগণ নৌকার পক্ষেই ভোট দেবে।’
নৌকার মনোনয়নবঞ্চিতরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে কি না— জানতে চাইলে সুবাস বলেন, ‘দলের স্বার্থে যাকে বিবেচনা করা হয়েছে, আমরা তার পক্ষেই আছি। মনোনয়ন যারা পায়নি, তারাও আছে। বঙ্গবন্ধুর সৈনিক কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয় না, আমিসহ আরও অনেকেও হইনি। দলের স্বার্থই এখন প্রধান। তাছাড়া মাশরাফি সংসদ সদস্য হিসেবে নড়াইলের যথেষ্ট উন্নয়ন করেছেন। তাই তার পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি আমরা।’
কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে বিএনপি এই জেলাতেও ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি জুলফিকার আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে আমরা নির্বাচন বর্জন করেছি। আমাদের কর্মী-সমর্থকরা ভোট দেবে না— এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এখন ভোটের মাঠে নৌকা আর মহাজোট প্রার্থী। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী নাই, তাই নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিরোধী দল না থাকলে সেটি কীসের নির্বাচন? গণতন্ত্রের নামে হলেও এই নির্বাচন শুধু তাদের নিজেদের জন্যই।’
নড়াইলের বাসিন্দা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ‘ভোট দিতে যাচ্ছি না। দেশে ভোট ছিল উৎসব। কিন্তু এখন আর সর্বজনীনতা নাই। নির্দিষ্ট কিছু ভোটার একাধিক ভোট দেওয়ার জন্য উৎসাহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের আশা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই নিজেরাই অন্যদের ভোট দিয়ে দেবেন। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানোর জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অপ-প্রতিদ্বন্দ্বীরা দাঁড়িয়ে গেছেন। মাশরাফির বিপক্ষে বিএনপির কেউ দাঁড়ালে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো, তা এখন হচ্ছে না।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
কবিরুল হক মুক্তি চন্দনা হক জাতীয়-নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নড়াইল নড়াইল-১ নড়াইল-২ ফয়জুল আমির লিটু মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা সংসদ নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থী