নতুন বই নিতে নৌকা নিয়ে স্কুলে শিশুরা
১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৯:৩৪
পিরোজপুর থেকে: পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মনোহরপুর বিলাঞ্চলের শিক্ষাার্থীরা নতুন বই নিতে স্কুলে আসে নৌকা বেয়ে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পেয়ে আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠে তারা। এরপর কমলমতি শিশু-কিশোররা বই নিয়ে নৌকা বেয়ে বাড়ি ফিরে ঝুঁকি নিয়ে। কারণ ওই এলাকার যুগযুগ ধরে বিরাজমান শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া আসার জন্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সমাধান হয় না।
বর্ষা মৌসুমে এ এলাকার শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তবে শীতের সময় তাদের কষ্ট হয় বেশি কারণ এ সময় খাল বিলে পানি থাকে না। শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। কোনো বাহনই চলে না তখন। তখন জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে স্কুলে ক্লাস নেওয়া হয়। তারপরও কাদা পেরিয়ে তাদের স্কুলে যেতে হয়। এ ছাড়া এই এলাকাড় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এক সেট পোশাক স্কুলে রেখে দিতে হয়।
সরকার আসে সরকার যায়। সমস্যা সমাধনের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যরা ভোট নিতে গিয়ে বিরাজমান সমস্য সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দেন ঠিকই কিন্তু রক্ষা করেন না। এ বছরও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনের প্রার্থীরা ভোট চেয়ে এই এলাকায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পোস্টার ব্যানার ঝুঁলিয়েছেন। ভোটে পাস করার জন্য ভাটারদের এখন খুবই তোষামোদ করছেন প্রার্থীরা। তবে ভোটে পাস করার পর এই সমস্যা সমাধান হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মনহরপুর প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিবাবকরা।
তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জোয়ার ভাটার তীব্র স্রোত উপেক্ষা করে শিক্ষা অর্জনের জন্যে নৌপথেই বিদ্যালয়ে যেতে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় তারা দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও, জ্ঞানের আলো সঞ্চয় করে দেশ ও জনগনের সেবা করার স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হয়নি তারা।
১ জানুয়ারি, ইংরেজি নবর্বষের প্রথম দিন। আজ সারাদেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। শিক্ষর্থীদের বই নেওয়ার দৃশ্য দেখতে পিরোজপুর জেলা সদর থেকে সকাল ৭টায় নাজিরপুরে যান প্রতিবেদক। নাজিরপুর উপজেলা হয়ে গাউখালী ইউনিয়নে পৌঁছান সাড়ে ৮টায়। গাউখালী থেকে ইঞ্জিলচালিত নৌকাযোগে মনোহর পর রওয়ানা হন তিনি।
প্রায় এক ঘণ্টা পর ৯টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের শিক্ষার্থীরা নতুন বই নিতে কনকনে শীত উপেক্ষা করে ঘনকুয়াশার মধ্যে নৌকা বেয়ে স্কুলে এসেছে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকরা তখনও পৌঁছাননি। সকাল ১০টার পরে শিক্ষকরা স্কুলে আসেন।
যদিও মনোহরপুর এলাকার শিক্ষার্থীসহ জনগণের জন্য চলাচলের জন্য ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এই কাজটুকু হয়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, প্রথমে একটি দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) খায়রুল আলম শেখ বিলাঞ্চলের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দুর্দশা নিজে ঘুরে দেখেন। তিনি ওই সময় মনহরপুর বিল এলাকার শিক্ষার্থী এবং জনগণের চলাচলের জন্য সড়ক এবং সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে চিঠি পাঠিয়েছিল। সাইক্লোন সেন্টার বিশুদ্ধপানির ব্যবস্থা করা হলেও ৬ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণ হয়নি।
নাজিরপুর থেকে উত্তর পূর্বকোণে এবং গাওখালী বাজার থেকে উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার দূরে মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি পিরোজপুর ভৌগোলিক সীমারেখার শেষ প্রান্তে। এর আশ-পাশে আরও ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বেশ উন্নতি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ছোট-ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুগের পর যুগ স্কুলে আসা-যাওয়া করে ছাত্র-ছাত্রীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এসব ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই এখন সরকারের উচ্চপদে চাকরি করছেন।
১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মনোহরপুর প্রাথমিক স্কুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারি চাকরি করে অনেকেই এরইমধ্যে অবসর নিয়েছেন। কেউ কেউ মারাও গেছেন। এখনও অনেকে কর্মরত রয়েছেন সরকারের উচ্চপদে। কিন্তু আজও পরির্বতন হয়নি মনোহরপুর স্কুলসহ বিলাঞ্চলের অন্যান্য স্কুলগুলোর।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মনোহরপুর প্রাথমিক স্কুলটি সরকারিকরণ করেন। এরপর অনেক সরকার আসছে কিন্তু স্কুলগুলোতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষরা সরকারের নীতিনির্ধারকসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে সমস্যা সমাধানের বারবার আশ্বাস পেয়েছেন কিন্তু সমাধানে কেউই এগিয়ে আসেনি।
এসব বিষয় নিয়ে মনোহরপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন জানান, বছরের ১২ মাসই শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ছয় কিলোমিটার রাস্তা হলে এই র্দুভোগ আর থাকে না।
তিনি জানান, স্কুলটি থেকে প্রতিবছরই শতভাগ শিক্ষার্থী এএসসি পরীক্ষায় পাস করে। এখানে একটি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের কথা থাকলেও তা নির্মাণ হয়নি। সাইক্লোন সেন্টারটি নির্মাণ করা হলে পাঠদানে আর ঝুঁকি থাকে না। এছাড়া ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হলে স্কুলের পরিবেশটাও পাল্টে যেত।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/ইআ