Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রচারের লড়াইয়ে সমানে সমান নৌকা-কাঁচি

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৫

রাজশাহী: বাগমারা উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৪ আসন। এই আসনটি পুর্নগঠিত হয় ২০০৮ সালে। এর আগে মোহনপুর-বাগমারা নিয়ে ছিল রাজশাহী-৩ আসন। এই আসন থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীও ছিল। পরে আওয়ামী লীগ থেকেও এই আসনে মন্ত্রিত্ব পায়। ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী আবদুল গফুরকে পরাজিত করে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হক। এরপর ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচত হন। ২০১৮ সালে বিএনপি প্রার্থী আবু হেনাকে পরাজিত করে ফের জয়লাভ করেন এনামুল। তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য এবার দলের মনোনয়ন পাননি বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সভাপতি। সেজন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বিজ্ঞাপন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ বাগমারা আসনে ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাঁচি প্রতীকের এনামুল হক, স্বতন্ত্র প্রার্থী মাথাল প্রতীকের বাবুল হোসেন, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের আবু তালেব প্রামাণিক, বিএনএমের নোঙ্গর প্রতীকের সাইফুল ইসলাম রায়হান ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মনোনীত ও গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চ সমর্থিত প্রার্থী আম প্রতীকের জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহীর নয়টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বাগমারা। এই উপজেলা থেকে বিএনপির আমলে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আল মুজাহিদীনের (জেএমবি) উত্থান ঘটে। তারা পুরো বাগমারাজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। বিএনপি নেতাদের সহযোগিতায় চলে হত্যাযজ্ঞ। এখান থেকে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে ‘বাংলা ভাই’ নামে পরিচয় ঘটে, যা সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। একসময় এই এলাকায় সর্বহারা পার্টির প্রভাব ছিল। যদিও এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সর্বহারা নিধনের নামে প্রতিষ্ঠাতা হয় জেএমবি। হারিয়েছে গেছে দুটি সংগঠনই। মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় জেএমবি। এই উপজেলাকে ‘রক্তাক্ত জনপদ’ বলা হয়। এখন এই এলাকায় শান্তির সুবাতাস বইছে। এখন ‘সর্বহারা পার্টি’ এবং জঙ্গিদের কোনো তৎপরতা নেই।

এই আসনে প্রচারে সমানে-সমান দুই প্রার্থী। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। উপজেলা আওয়ামী লীগ ও জেলা আওয়ামী লীগ কাজ করছে নৌকা প্রতীকের পক্ষে। নিজস্ব সমর্থক নিয়ে কাজ করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। কালামের পক্ষে একাট্টা আওয়ামী লীগ। তবে এই দুই প্রার্থীর সমর্থকরা জড়িয়ে পড়ছেন সংঘর্ষে। ঘটছে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। এসব ঘটনা নিয়ে এলাকায় ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।

স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, এনামুল হক উন্নয়ন করলেও তার কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ছিল। তিনি এলাকার মানুষদের সঙ্গে মিশতেন না। সবসময় চলাফেরা করতেন গাড়িতে। সঙ্গে থাকত নিজস্ব প্রটোকল। কালাম তার ঠিক উল্টো। তাহেরপুর পৌর মেয়র থাকা অবস্থায় তিনি এলাকার মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন। তবে যে প্রার্থী এবার জিতুক ভোটারদের আশা তারা মানুষের সঙ্গে থেকে কল্যাণে কাজ করবে।

বাগমারা উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ বাজার হাটগাঙ্গোপাড়া। এই বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাড়িগ্রাম। পেশায় ভ্যালচালক এখানকার ভোটার আফজাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময় উন্নয়ন ভালো হয়েছে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণও হয়েছে। এছাড়াও এই উপজেলায় বিদ্যুতও আছে। ১০ বছর আগেও সবার ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না।’ যে প্রার্থীই জিতুক না কেন উন্নয়ন যেন অব্যাহত থাকে আশা এই ভোটারের।

বাগমারা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের চায়ের দোকান কিংবা বাজারে নির্বাচন নিয়ে আলোচনামুখর স্থানীয়রা। কে জিতবে ভোটে তা নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। তবে এই উপজেলার প্রধান কাজই হচ্ছে কৃষি। চায়ের দোকানের আড্ডায় মানুষরা বলছেন, এবার কৃষিখাতকে গুরুত্ব দিলে আরও ভালো হবে। সেইসঙ্গে ভাঙতে হবে বাজার সিন্ডিকেট। এই আসন থেকে কে জিতবে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ভোটারদের। তবে তাদের প্রত্যাশা সরকার যেন এবার কৃষিখাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক দিন আগে উপজেলা আওয়ামী লীগ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সংসদ সদস্য এনামুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিকদারীর সালেহা-ইমারত কোল্ড স্টোরেজে এই সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন এনামুল হক। প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার। সভায় নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য একসঙ্গে মাঠে কাজ করার অঙ্গীকার করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। সভা শেষে সংসদ সদস্য এনামুল হক মুষ্টিবদ্ধ হাতে নেতাকর্মীদের শপথবাক্য পাঠ করান। যেখানে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের নৌকার বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার অঙ্গীকার করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ৫৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সংসদ সদস্য এনামুল হক মুষ্টিবদ্ধ হাতে নেতা-কর্মীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। তার সামনে থাকা দলের বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক নেতা-কর্মী একই ভঙ্গিতে শপথ করেন। ওই ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শপথ করিতেছি যে, দলের নেতা হিসেবে, আমার ওপর যে কোনো দায়িত্ব অর্পিত হবে, তা সুষ্ঠু ভাবে পালন করিবো। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের নৌকা প্রতীক বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবো না।’

নির্বাচনে এনামুল হক দলীয় মনোনয়ন পাননি। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। তবে এনামুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের পর গত ১৯ ডিসেম্বর এনামুল হক তার অনুসারী নিয়ে উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা করেন। সেখানে তিনি নৌকার বদলে নিজের কাঁচি মার্কায় ভোট চান। ওই দিনই তিনি প্রথম নৌকার বদলে কাঁচিতে ভোট চেয়েছেন।

এনামুল হকের কয়েকজন সমর্থক উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য এনামুল হকের ওই শপথের কারণে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। ভোটারদের কাছে গেলে পাল্টা কথা শুনতে হচ্ছে। কারণ, তিনি আমাদের নৌকা প্রতীকে থাকার জন্য শপথ করিয়েছিলেন। আমরা সেই শপথ ভাঙতে পারছি না।’

সংসদ সদস্যের সঙ্গে শপথ নেওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনিসহ দলের মূলধারার নেতারা শপথ রক্ষা করে চলেছেন। নেতারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে শপথ রক্ষা করে নৌকার পক্ষে কাজ করছেন। সংসদ সদস্য এনামুল হকের শপথ অনুসারে নৌকার বিজয় নিয়েই তারা ঘরে ফিরবেন।’

শপথবাক্য পাঠ করা এনামুল হকের অনুসারী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য তাদের যে শপথ পাঠ করিয়েছেন, তা ভাঙার উপায় নেই, তাই নৌকার পক্ষেই কাজ করছেন।’

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বাগমারা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে। তিনি নারী কেলেঙ্কারিতে বেশ কয়েকবার জড়িয়ে ছিলেন। এছাড়াও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে জেএমবি ও সর্বহারার ক্যাডারদের দলে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা এবার বেশ কয়েকজন দলীয় মনোনয়নের আশায় ছিলাম। অবশেষে অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি জিতলে এই এলাকার আরও পরিবর্তন হবে।’

তবে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য সংসদ সদস্য এনামুল হককে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য এনামুল হকের মিডিয়া কর্মকর্তা শামীম রেজাকে ফোন দিলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘স্যার প্রচারে ব্যস্ত আছেন। তিনি এখন কথা বলতে পারবেন না। আপনার জরুরি হলে যেখানে তিনি প্রচার চালাচ্ছেন সেখানে আসতে পারেন।’

এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরও চার প্রার্থী। এই আসনে বিএনএম থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম রায়হান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রচার চালাতে গিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছি। মানুষজন আমাকে ভালো সমর্থন দিচ্ছেন। অন্য প্রার্থীদের থেকে এগিয়ে আছি।’

এই আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এনপিপির ভাইস চেয়ারম্যান জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হয়তো ভোটে জিততে পারব না। তবে আমার পজিশন খুব ভালো। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছি। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তাই এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আমাদের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরাও এসে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন।’

জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও উপজেলা সভাপতি আবু তালেব প্রামাণিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছি। প্রতিটি ইউনিয়নে একটি নির্বাচনি ক্যাম্প ও দুটি পৌরসভায় দুটি ক্যাম্প করেছি। অন্য প্রার্থীদের সমস্যা হলেও আমার প্রচার চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য এনামুল হক হলেও পুরো বাগমারাতে আমার নাম-ডাক আছে। সবার বিপদে আপদে ছুটে গেছি। তরুণরা আমাকে বেশ সমর্থন করছেন। তারা ভোট দিয়ে জিতিয়ে নিয়ে আসবেন। পুরো আওয়ামী লীগ আমার সঙ্গে আছেন। সবাই আমাকে সহযোগিতা করছেন নির্বাচনে জেতার জন্য। এনামুল হককে নিয়ে বাগমারাবাসী অতিষ্ট ছিল। তারা এবার মুক্তি পাবে।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী আমার নির্বাচন প্রচারে বাধা দিচ্ছেন। কর্মীদের দিয়ে আমার সমর্থকদের মারধর করছেন। ক্যাম্প পুড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি নিজেই নিজের সমর্থকদের উপরে হামলা চালিয়ে আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভোটারদের ভয়ভীতিও দেখাচ্ছেন। তবে এই নির্বাচনে আমি জয়ী হব। তার পক্ষে কেউ নেই এটা প্রমাণিত।’

উল্লেখ্য, বৃহত্তম বাগমারা উপজেলায় ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৬ হাজার ৩৫২ জন। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৯ জন। নারী ভোটার ১ লাভ ৫২ হাজার ৫০০ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন তিন জন।

সারাবাংলা/পিটিএম

আবুল কালাম আজাদ এনামুল হক কাঁচি নৌকা বাগমারা রাজশাহী-৪

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর