‘এমন বিরোধী দল চাই যারা সহিংসতা-সন্ত্রাসের বাইরে রাজনীতি করবে’
৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:০০
মোহাম্মদ এ আরাফাত। শিক্ষক, শিক্ষাবিদ। কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট সদস্য ও ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান উপদেষ্টা। ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান তথা নায়ক ফারুকের মৃত্যু হলে আরাফাতকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। গত বছরের জুলাইয়ের উপনির্বাচনে জয় পেয়ে মাস ছয়েকের জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবারেও আওয়ামী লীগ তাকেই এই আসনে প্রার্থী করেছে।
নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই সোমবার (১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় মোহাম্মদ এ আরাফাত সময় দিয়েছেন সারাবাংলাকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করা, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ সংশ্লিষ্ট বিভন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার নিউজরুম এডিটর আতিকুল ইসলাম ইমন
সারাবাংলা: বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: সবাই জানে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে কোনো রিগিংয়ের প্রয়োজন নেই। কাজেই এটা রিগিং-ফ্রি নির্বাচন হবে। যুক্তির খাতিরে বলছি, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় কেউ এটা স্টাবলিশ করতে চাইলেও পারবে না যে ভোটে কারচুপি (রিগিং) হয়েছে। তার অর্থ, নির্বাচন অবাধ হচ্ছে। এখন নির্বাচন সুষ্ঠু (ফেয়ার) হচ্ছে কি না, সেটি একটি বিষয়। নির্বাচন সুষ্ঠুও হচ্ছে। অনেকে ভাবছে, একটা বড় দল নির্বাচনে আসেনি বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। কিন্তু ওই দল নির্বাচনে না আসার কারণে নির্বাচন ফেয়ার না হলে এর দায় কার? এর জন্য কিন্তু এককভাবে আওয়ামী লীগকে দায় দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না বিএনপিকে নির্বাচনে জোর করে নিয়ে আসার।
যদি আমি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে বিএনপির সন্দেহ ছিল এভাবে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কারচুপি করত, তাদের জিততে দিত না, তাহলে কী হতো? বিএনপি হারত, আওয়ামী লীগ জিতত। এখনো তো তাই হচ্ছে। আওয়ামী লীগ আবার জিতে ক্ষমতায় আসবে। বিএনপি অন্তত নির্বাচনে এসে দেখতে পারত। কিন্তু সেই জায়গা থেকেও বিএনপি সবাইকে বঞ্চিত করল। বিএনপি নির্বাচনে আসার পর কোথাও কারচুপি হলে বলতে পারত যে এখানে কারচুপি হচ্ছে। কিন্তু এখন তাদের এ কথা বলার অধিকারই নেই। কারণ তারা নির্বাচনে আসেইনি। আর বিএনপি নির্বাচনে না এলে কোনো বোকাও মনে করে না আওয়ামী লীগ জিতবে না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কারচুপি করে জিততে হবে না। কাজেই নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠুও হবে, না হওয়ার কোনো কারণ, যুক্তি কোনোটাই নেই।
সারাবাংলা: বারবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বিএনপি নির্বাচনে কেন এলো না বলে আপনি মনে করেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: আমরা তো সবসময় ওপেন ছিলাম যে বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এখন বিএনপির নেতা নেই। তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, পলাতক। তারা মনে করে, তারা নিজেরা যেহেতু নির্বাচন করতে পারছে না, তার দল নির্বাচন করে যদি কিছু আসন জিতে সংসদে বিরোধী দল হয়, তাহলে তারেক রহমান দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এই ভয়ে দলকে নির্বাচনেই আসতে দিতে চায় না। বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, সবাই নির্বাচনে আসতে চান। কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ নেতা তারেক রহমান তাদের আসতে দিতে চায় না। বিষয়টা এখানে আটকে আছে।
সারাবাংলা: আওয়ামী লীগ বলে আসছে ভোটারদের অংশগ্রহণ মানেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে এবং তারা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় অনেক আসনে সে অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। এতে ভোটার অংশগ্রহণ কম হতে পারে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: যখন একটা বড় দল নির্বাচনে থাকে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভোটার কিছুটা কম হবে। আবার সেই বড় দল যখন ধারাবাহিকভাবে অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষকে পুড়িয়ে মারে এবং হুমকি-ধমকি দিয়ে নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দেয়, তখন কিছু মানুষ ভয়ে ভীত হয়ে ভোট থেকে বিরত থাকে। সবমিলিয়ে একটা ইমপ্যাক্ট থাকবে। সেটার দায় তো আওয়ামী লীগকে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশের ১০ শতাংশ ভোটার কিন্তু বিদেশে থাকেন। ফলে ভোট টানতে হচ্ছে ৯০ শতাংশ ভোটারের মধ্য থেকে। আবার অনেক আসনের ভোটার মাইগ্রেশন করে অন্য এলাকায় গিয়ে বসবাস করেন। যেমন এই আসনে (ঢাকা-১৭) প্রায় এক লাখ ভোটার আর এখানে বসবাস করেন না। এখন উদাহরণের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে এখানে বসবাসরত সবাই ভোট দেবেন, তাহলেও কিন্তু আমার টার্নআউট দেখাবে ৬০ শতাংশ। তো আমি টার্নআউট বাড়াব কী করে? এই জায়গাগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
এই আসনে আমার উপনির্বাচনে অফিশিয়ালি টার্নআউট হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত টার্নআউট, অর্থাৎ উপস্থিত ভোটারদের হিসাব করলে টার্নআউট হয়েছিল প্রায় ২২ শতাংশ। পাঁচ মাসের এত স্বল্প মেয়াদের একটি নির্বাচনে যদি ২২ শতাংশ ভোট আসে, আমি তো মনে করি এটা ভালো টার্নআউট। আর জাতীয় নির্বাচন যেহেতু পাঁচ বছর মেয়াদি, এখানে টার্নআউট আরও ভালো হবে বলে আমি মনে করি। এখানে অ্যাকচুয়াল টার্নআউট দেখতে হবে। আমি মনে করি, বিএনপির বর্জন, হুমকি-ধমকি, ভোটার মাইগ্রেশন সব হিসাবে নিয়ে এখানে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ টার্নআউট হলে সেটা যথেষ্ট ভালো নির্বাচন হবে।
সারাবাংলা: দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের অবাধ সুযোগ দেওয়ায় আওয়ামী লীগের মধ্যেই বিভাজনের আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অদ্ভুত ফেনোমেনা আছে। ভারতেও দেখবেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলেই সংঘর্ষে রূপ নেয়। তখনই সহিংসতাটা দেখি। এটা দুই দলের মধ্যে হোক আর নিজের দলের মধ্যেই হোক। এটি দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা। নির্বাচনকে আমরা শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে নিতে পারি না। এটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি না, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা সমস্যা। ফলে যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, সেখানেই দেখা যাচ্ছে তা সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারবেন না নিজ দলের মধ্যে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। এটা বলার সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত, আপনি ঠিকই বলেছেন, নিজ দলের মধ্যে এটা হলে দলের কিছু ক্ষতি হয়। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এই ক্ষতিটা যদি একটা কস্ট হিসেবে ধরেন, আমাদের কিছু বেনিফিটও আছে। কস্ট-বেনিফিট বিশ্লেষণ করে কস্টের চেয়ে বেনিফিট বেশি হলে কিন্তু বেনিফিটের পক্ষে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরাও আলাপ-আলোচনা করে দেখেছি, আমাদের কী কী ক্ষতি হবে আর লাভ কী হবে। আমরা যেহেতু চেয়েছি বিএনপি না এলেও একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে, আমরা চেয়েছি বিশ্ববাসী দেখুক আওয়ামী লীগ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে ভয় পায় না, সেটা বিএনপি আসুক আর নিজের দলের হোক বা যেভাবেই হোক, সে জন্য আমরা প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সবাই নির্বাচন করুক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো। বিএনপি এলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু ওদের তো আমরা ঘাড় ধরে আনতে পারব না। তাদের পালাতক নেতা তার নিজ স্বার্থে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে দেবে না। সেক্ষেত্রে আমরা সেকেন্ড বেস্ট পসিবল অপশনে গেছি। না হলে আবার ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলবেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। সেটার দরকারটা কী?
সারাবাংলা: বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হওয়ায় দেশে বর্তমানে সত্যিকার অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই বলে অনেকেই মত দিয়ে থাকেন। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল থাকাটাও জরুরি। জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দল হলেও তারা সরকারের সঙ্গে জোটভুক্ত। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিরোধী দল নিয়ে কী ভাবছে?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: শক্তিশালী বিরোধী দল গণতন্ত্রের জন্য খুবই দরকার। কিন্তু এমন কোনো বিরোধী দল দরকার নেই যেটা সন্ত্রাসী বিরোধী দল। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। আমরা চাই একটা সুন্দর, শক্তিশালী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের একটি বিরোধী দল থাকুক। কিন্তু আমরা এটা চাই না যে জামায়াত, জঙ্গি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী সবাই মিলে একটা বিরোধী দল বানিয়ে থাকুক। তারা মানুষকে পুড়িয়ে মারুক, রেললাইন বিচ্ছিন্ন করুক— ওই জিনিস আমরা চাই না। আমরা এমন ভালো বিরোধী দল চাই যারা নীতিগত বিভিন্ন ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক করবে, নির্বাচনে প্রকৃত অর্থেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। নির্বাচনে আসার নামে মনোনয়ন বাণিজ্য করবে না। সহিংসতা-সন্ত্রাসের বাইরে রাজনীতিটা করবে, এরকম বিরোধী দল আমরা চাই। এটাই আমাদের ভাবনা।
সারাবাংলা: শ্রম আদালতের রায়ে ড. মোহাম্মদ ইউনুসের ৬ মাসের জেল হয়েছে। এটা নিয়ে কি সরকার নতুন করে বিদেশি চাপে পড়তে পারে?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: আমরা এসব কিছু (বিদেশি চাপ) থোড়াই কেয়ার করি। বাংলাদেশ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী চলবে। দেখুন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এতগুলো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, আইনের শাসন না থাকলে হতো? আমরা আইনের শাসনে চলছি। হলমার্ক অন্যায় করলে যেমন ধরা হয়, তেমনই ড. ইউনুস সাহেব অন্যায় করলে আপনি ধরবেন না? যাকে আপনার পছন্দ না তাকে আইন অনুযায়ী সাজা দিলে আপনার কাছে কম মনে হচ্ছে, আবার যাকে পছন্দ তাকে আইন অনুযায়ী কম সাজা দিলেও আপনার কাছে বেশি মনে হচ্ছে। এটি আসলে দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা।
সারাবাংলা: নির্বাচিত হলে ব্যক্তিগতভাবে আপনার নির্বাচনি আসন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কী পরিকল্পনা আছে? এই এলাকার জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে কী করতে চান?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: ঢাকা-১৭ আসনে আটটি বস্তি আছে। আমি বস্তিগুলো পুনর্বাসন করব। গুলশান, বনানী, বারিধারা ছাড়া এই আসনে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। কালাচাঁদপুর, শাহজাদপুর, নর্দা, সাততলা আদর্শনগর, কড়াইল আদর্শনগর, এদিকে কালীবাড়ী থেকে মাটিকাটা পর্যন্ত, মাঝখানে মানিকদি, তারপর আছে ভাষানটেক— এসব এলাকায় অনেক কাজ করার আছে। আওয়ামী লীগের এমপি না থাকার কারণে গত ২০ বছরে এখানে অনেক কিছু করা যায়নি। এগুলা আমি করার চেষ্টা করব।
সারাবাংলা: আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্বাচন শুধু আনুষ্ঠানিকতামাত্র কি না?
মোহাম্মদ এ আরাফাত: এই নির্বাচন একা আওয়ামী লীগের না। নির্বাচন একটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। দেশের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, দেশের জনগণের জন্য এটা করতেই হবে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব, আমরা করছি। যারা যারা এই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তারাও নির্বাচন করছে। আর যারা করছে না, আমি মনে করি তারা গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি, সন্ত্রাসী শক্তি।
সারাবাংলা: সারাবাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ এ আরাফাত: সারাবাংলাকেও ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/আইই/টিআর
আতিকুল ইসলাম ইমন জাতীয়-নির্বাচন ঢাকা ১৭ বিরোধী দল মোহাম্মদ এ আরাফাত সংসদ নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থী