Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দু’বেলা পেটভরে ভাত— যাদের কাছে ভোট মানে এটুকুই

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:১২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তিন মাস ধরে আমি ভালো করে সবজিও কিনি না। ৮০ টাকার নিচে সবজি নেই। তিন সন্তানকে ভাত দিতে হয় শুধু পাতলা ডাল, নয়তো কখনও একটু ভাজি কিংবা ভর্তা দিয়ে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, ইনকাম তো বাড়েনি। বাজারে গেলে কান্না আসে। সংসার চালাতে পারছি না। বৌ-বাচ্চার সামনে মুখ দেখাতে কষ্ট হয়। ভোট হলে কি সবজির দাম কমবে?’— কথাগুলো বলছিলেন মো. ইউসুফ নামে এক ট্রাকচালক।

১০ বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরে মিনিট্রাক চালান তিনি। এখন মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে থাকেন নগরীর বন্দরটিলা এলাকার নয়ারহাটে। ইউসুফ হয়তো ৭ জানুয়ারি হয়তো ভোট দিতে যাবেন, নয়তো যাবেন না। তার কাছে ভোট এমন কোনো উৎসাহের বিষয় নয়, তার বেশি বাস্তবতা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধটা। তার যুক্তি, ভোট দিয়ে তাদের ভাগ্য বদল হয় না। ভোট শেষ হলেই জনগণকে ভুলে যান প্রার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৩ জানুয়ারি) দুপুরে নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে একটি কারখানা থেকে তৈরি পোশাকের বিভিন্ন সরঞ্জাম ট্রাকে বোঝাই করছিলেন ইউসুফ। যাবেন সিইপিজেডে। ট্রাক নিয়ে রওনা দেওয়ার আগে তার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের।

চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের ভোটার ইউসুফ আরও বলেন, ‘১৬ হাজার টাকা বেতন পাই। আট হাজার টাকা ঘর ভাড়া চলে যায়। বাকি থাকে আট হাজার। পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত দিই কীভাবে আর নিজে খাই কীভাবে। নিজে দুপুরে ভাত খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি।’

ভোট নিয়ে কথা তুলতেই খানিকটা ক্ষ্যাপে যান। বলেন, ‘ভোট দেব কি দেব না জানি না। দিতেও পারি, না-ও দিতে পারি। ভোট দিলে কি আমাদের মতো গরিবদের কোনো উন্নতি হবে?’

প্রায় দু’বছর ধরে বাজারে উত্তাপ চলছে, দিশেহারা গরিব-মধ্যবিত্ত। এর জন্য করোনাভাইরাস প্যানডামিক ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু পেটের ক্ষুধা কি যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, বিশ্বমন্দা- এসব কঠিন নাগরিক ভাষা বোঝে?

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যেই বেজেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দামামা। কেউ বলছেন ভোট দিতে আসুন, কেউ বলছেন ভোট বর্জন করুন। আর ব্যস্ত শহরের পিচঢালা রাজপথে রিকশা-ভ্যান টেনে নিয়ে যাওয়া কিংবা পোশাক কারখানায় সুঁই-সূতায় পেটের তাগিদ মেটানোর গল্প বোনা সেই ‘সেলাই দিদিমণি’ কী ভাবছেন, কী বলছেন, সেটি জানার চেষ্টা করেছে সারাবাংলা।

তিন পোলের মাথায় কথা হয় ৬২ বছর বয়সী রিকশাচালক খোরশেদ আলমের সঙ্গে। বাড়ি কুমিল্লায়, ভোটারও সেখানে। বাড়িতে চাষাবাদ করতেন। ধান-শাকসবজির আয়ে পোষায় না এখন। বাস্তবতার কাছে হার মেনে চট্টগ্রাম শহরে এসে রিকশা চালিয়ে কোনোভাবে দিনাতিপাত করছেন। মাস শেষে হাজার চারেক টাকা বাড়িতে পাঠান।

ভোটের কথা তুলতেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অনুরোধে ঢেঁকি গিলে বলেন, ‘নির্বাচন কি আর আগের মতো আছে? আমি মুজিবের নির্বাচন দেখেছি, জিয়া-এরশাদের নির্বাচনও দেখেছি। এখনও দেখছি। সব দল একসঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচন করুক, তখন ভোট দিতে আনন্দ লাগবে। দেশের উন্নয়ন দরকার, গরিবের বাঁচারও দরকার। আমরা তো এখন গরিবও নই, গরিবের নিচে আরও কিছু থাকলে সেটা। মাছ-মাংস দূরে থাক, ডাল-সবজি দিয়েও তো প্রত্যেক বেলা ভাত খেতে পারি না। প্রায় দুপুরে রুটি-কলা খেয়ে কাটাই। ভোট দিলে কি আমাদের সুদিন আসবে?’

এমন কষ্টের কথা বলতে হবে বলেই সম্ভবত তিন পোলের মাথায় খোরশেদের মতো আরও তিন রিকশাচালক প্রশ্ন শুনে এড়িয়ে যান।

শীতের দুপুর। রিয়াজউদ্দিন বাজারে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন ভ্যানচালক। নির্বাচন প্রশ্নে কয়েকজনের সাফ উত্তর, ‘ভোট দিতে ইচ্ছা হলে, গিয়ে দিয়ে আসব। কথা যত কম বলব, তত নিরাপদ।’ কিছুক্ষণ পর তাদের মধ্যে থেকে এগিয়ে এলেন রহমত আলী নামে এক ভ্যান চালক। তিনি চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনের ভোটার।

রহমত আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি পাবলিক, আমি কষ্ট করে মরছি। আর ওরা কোটিপতি। কোটি টাকার গাড়ি থেকে নেমে আমারে জড়াই ধরে। বলতে ইচ্ছে করে, ভোট দেবো কিন্তু আমার পেটে ভাত দেন। বলতে পারি না।’

রুকু মিয়া নামে আরেক ভ্যানচালকও এগিয়ে এলেন, তিনি অবশ্য রাজনীতি সচেতন, কথাবার্তায় সেটা ভালোই বোঝা গেল। ৫৮ বছর বয়সী রুকু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি কেন নির্বাচনে এল না, বুঝি না। আসলে একটা খেলা হতো। আমরা ভোট দিয়ে মজা পাইতাম। আমরা মিন্ন্যত (মেহনত) করে খাই। দল দিয়ে আমাদের লাভ নাই। একবার এক নেতারে বলতে শুনছিলাম, আওয়ামী লীগ-বিএনপি যার যার-মিন্ন্যতা মানুষ এক কাতার। এত ভালো লাগছিল কথাটা ! আমাদের একটাই কথা- ভোট দেবো, কিন্তু আমাদের পেটে ভাত দিতে হবে। চুরি-ডাকাতি শিখি নাই, মিন্ন্যত করে খাই।’

পাইকারি পণ্যের রিয়াজুদ্দিন বাজারে কাজ করে হাজারো শ্রমিক। কেউ উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা তরিতরকারি খালাস করে আড়তে তোলেন, কেউ ধনীর বাজারের বোঝা বয়ে নিজের পেটে ভাত দেন। তাদের একজনের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের। প্রথমে বলতে না চাইলেও পরে জানান, তার নাম মো. আলম।

চট্টগ্রাম-৯ আসনের ভোটার ৩৮ বছর বয়সী আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শ্রমিক, আমরা পেটনীতি করি। রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ নাই। সরকারের সঙ্গে দেখা হলে বলে দিয়েন, বৌ-বাচ্চা নিয়ে কষ্টে আছি। ভোটের পর জিনিসপত্রের দাম যেন একটু কমায়।’

আলমের কথা শেষ হতে না হতেই আরেকজন এসে বলেন, ‘সাহেবের বাজার করে নিজেই বাজার করতে পারি না।’ তার নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নাম দিয়ে কি করবেন, আবার জেলে ঢুকিয়ে দেবে।’ ভোট দেবেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই শ্রমিক বলেন, ‘ভোট দিতে হলে বাড়িতে যেতে হবে। গাড়ি ভাড়া কে দেবে !’

ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আবদুর রাজ্জাক। কুমিল্লার ভোটার রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি ভোটে আসেনি সেটা তাদের ব্যাপার। তারা রাজনীতি বোঝে না। ভোট দিতে বাড়ি যাব। নৌকায় ভোট দেব।’

চট্টগ্রাম-১১ আসনের ভোটার প্যাসিফিক জিনস কারখানার কর্মী জয় বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভোটের দিন বন্ধ দেবে বলে শুনেছি। পছন্দের কোনো প্রার্থী নেই। যারা আছে সবাই তো এক দলের। দেখা যাক, ভোট দিতে যাব।’

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভোট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর