হাল ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি
৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:০০
ঢাকা: সরকার পতনের লক্ষ্যে টানা ৬৭ দিন ‘কঠোর’ আন্দোলনের পর নির্বাচনের আগে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। এখন আর ভোট প্রতিহত নয়, ভোট বর্জনকে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) স্থায়ী কমিটির জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচন প্রতিহত করার পরিকল্পনা তাদের নেই। অর্থাৎ ভোট বর্জনের মাধ্যমে নির্বাচনকে জাতির সামনে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘অর্থহীন’ প্রমাণ করাই তাদের আপাত লক্ষ্য।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কোনো রাখ-ঢাক না করে সরাসরি বলেছেন, ‘আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছি, নির্বাচন বর্জন করুন। আমাদের নেতাকর্মীরাও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে। আমাদের উদ্দেশ্য দলীয় প্রতিবাদটা জাতির কাছে জানানো, বিশ্বের কাছে জানানো।’
২০১৪ সালে জামায়াত-বিএনপির লাগাতার অবরোধ, নাশকতা, সহিংসতার মধ্যেই ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ফলে ভোট গ্রহণের আগের রাতেই সারাদেশে প্রায় পাঁচ শ ভোটকেন্দ্রে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগের দিন থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং কয়েক শ মানুষ আহত হন। নির্বাচনের দিনে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, প্রধান একটি জোটের নির্বাচন বয়কট ও রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।
পূর্বের এই ‘ভয়ংকর’ অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটাই জিজ্ঞাসা— ৭ জানুয়ারি কী করবে বিএনপি? জোট সঙ্গীদের নিয়ে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন প্রতিহত করবে? নাকি ভোট বর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তারা?
বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারাবাংলাকে তারা জানান, নির্বাচন প্রতিহত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তাদের নেই। আপাতত ভোট বর্জনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। ভোটের আগের দিন থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার যে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে বিএনপি। এর চেয়ে বেশি কিছু করার সক্ষমতা এই মুহূর্তে তাদের নেই।
দলীয় সূত্রমতে, দেশি-বিদেশিদের কাছে নির্বাচনকে ভোটারহীন ও প্রশ্নবিদ্ধ করার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি। কারণ ২০১৪ সালে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে যে পরিবেশ তারা তৈরি করেছিল, সে রকম কিছু করার মতো সাংগঠনিক শক্তি এই মুহূর্তে তাদের নেই। তার ওপর নির্বাচন প্রতিহত করার হুমকি দিয়ে সহিংস আন্দোলনে গেলে বিএনপির ওপর থেকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের শেষ সমর্থনটুকুও উঠে যেতে পারে— এমনটিই মনে করছেন দলটির নীতি নির্ধারকেরা।
অবশ্য নির্বাচন যে প্রতিহত করা যাবে না, সেটি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন বিএনপি নেতারা। তারা মূলত তাকিয়ে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। মার্কিনিদের পরামর্শেই আন্দোলনের ছক আঁটছিলেন তারা। কিন্তু সেই ছক খুব একটা কাজ দেয়নি।
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর ব্যাকফুটে চলে যায় বিএনপি। এরপর এ পর্যন্ত চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল ও ১২ দফায় ২৪ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে সরকারকে চাপে ফেলতে পারেনি তারা। এরপর ভোট ঠেকাতে ভোট বর্জনের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। মানুষকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে এখন পর্যন্ত ১৪ দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেছে তারা। এতেও কোনো প্রভাব পড়েনি ভোটের রাজনীতিতে।
এদিকে গত ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের ভাওয়ালে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেললাইন কেটে ফেলায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার শিকার হলে একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এর পর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁওয়ে ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুন দিলে চারজন যাত্রী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। এই দুটি ঘটনায় টনক নড়ে বিএনপির হাইকমান্ডের।
কারণ ২৫ ডিসেম্বর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, রেল লাইনে নাশকতা করে সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতি সঞ্চার এবং ব্যাপক প্রাণনাশের পরিকল্পনা থেকে যুবদলের সভাপতি টুকুর নির্দেশে গাজীপুরের শ্রীপুরে রেললাইন কাটেন ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান যুবদল নেতা মো. ইখতিয়ার রহমান কবির, লালবাগ থানার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো. ইমন হোসেন।
পুলিশ জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশে গাড়িতে আগুন দিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক ত্রাস তৈরির চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখন বিএনপির হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ আসে নিরাপদ বাহন হিসেবে পরিচিত রেলে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর। দলের হাইকমান্ডের এই নির্দেশে ট্রেনে চলাচল করা মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াতে ও রেল চলাচল বিঘ্ন করতে নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়।
পুলিশের তথ্য বলছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবিরকে নির্দেশ দেন। ইখতিয়ার রহমান কবির গাজীপুর আজিমুদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক তোহা ও মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তোহা ও মাসুম মিলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার শরণাপন্ন হন। পরে হাসান আজমলের বাসায় মিটিং করে কৌশল ঠিক করেন তারা।
পরকিল্পনা অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর ইমনের বাসা থেকে যন্ত্রপাতি গাজীপুর নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিন ইমন ও কবির কমলাপুর থেকে ট্রেনে করে জয়দেবপুর রেল স্টেশনে যান। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তোহা ও মাসুম যাতায়াতের জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া করেন এবং গ্যাস সিলিন্ডার কেনাসহ সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। এরপর ১৩ ডিসেম্বর রাতে স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাওয়ার পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন তারা। পুরো প্রক্রিয়াটি নেপথ্য থেকে তদারকি করেন সুলতান সালাহউদ্দন টুকু— জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছে— কর্মসূচি ঘিরে এ ধরনের অঘটন ঘটলে এর দায় বিএনপি এড়াতে পারবে না। এতে সারাবিশ্বে যেমন আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তেমনি দলের নেতাকর্মীরাও ফেঁসে যাবে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মূল অপরাধীকে শনাক্ত করা বর্তমান যুগে খুব বেশি কঠিন কাজ না। এরই মধ্যে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেললাইন কাটার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারসহ সব ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
একই সঙ্গে হরতাল-অবরোধে নাশকতার দায়ে দলটির নেতাকর্মীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নীতির আওতায় আসতে পারেন বলেও শঙ্কা রয়েছে বিএনপিতে। নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটলে আন্দোলনকারী দল হিসেবে এর দায় বিএনপির ওপরই বর্তাবে। এভাবে এ কূল-ও কূল দুই কূলই হারাবে তারা। এসব ভেবেই নির্বাচন প্রতিহতের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বর্জনে সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে বিএনপিকে।
এর মধ্যেই অবশ্য আজ শনিবার (৬ জানুয়ারি) বিএনপি ঘোষিত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরুর আগের রাত, তথা শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনটির পাঁচটি বগি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ট্রেন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চারটি মরদেহ। দগ্ধ ও অসুস্থ অবস্থায় পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কে বা কারা এই ট্রেনে আগুন লাগিয়েছে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। তবে ডিএমপি একে নাশকতা ও পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে করছেন। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা এখনই বলা যাবে না। তবে এটি যে নাশকতা, সেটি স্পষ্ট।’ এ ঘটনার তীরও বিএনপির দিকেই যেতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি লগি-বৈঠার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, সংঘাতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, অস্ত্রের রাজনীতিতেও বিশ্বাস করে না। বিএনপির লক্ষ্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই বিতর্কিত, একতরফা ডামি নির্বাচন বর্জন করা।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
জাতীয়-নির্বাচন নাশকতা নির্বাচন প্রতিহত নির্বাচন বর্জন বিএনপি সংসদ নির্বাচন