দ্বাদশের ভোটে ২ পক্ষে বিভক্ত পাহাড়ের ৪ রাজনৈতিক দল
৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:১১
রাঙ্গামাটি: ভৌগলিকভাবে দেশের প্রায় এক-দশমাংশজুড়ে অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের। আয়তনে বড় হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে জনসংখ্যা নগণ্য। প্রতিটিতে একটি করে পাবর্ত্য তিন জেলায় সংসদীয় আসন মাত্র তিনটি। বরাবরই এই এলাকায় স্থানীয় বা জাতীয় যেকোনো নির্বাচনেই আঞ্চলিক দলগুলো ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এবারের নির্বাচনে পার্বত্য তিন আসনের কোনোটিতেই নেই আঞ্চলিক কোনো দলের প্রার্থী।
এ পরিস্থিতিতে ভোটগ্রহণের আগেই ভোটের ফলাফল অনুমান করে ফেলছেন পাহাড়ের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটাররা। তিন পার্বত্য জেলায় নৌকা তথা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ‘প্রতিযোগিতাহীন জয়’ নিয়ে কোনো সংশয় দেখছেন না তারা। বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের ভাষ্য, ‘নিয়ম রক্ষার ভোটে’ নৌকাই জিতবে। তবে আনুষ্ঠানিকতার কারণে চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল দুইটি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে।
ভোটকে নিরুৎসাহিত করছে জেএসএস-ইউপিডিএফ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রতিহতের’ ঘোষণা থেকে সরে এসে ভোট ‘বর্জনের’ কথা বলছে দেশের ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ বিএনপি। সারাদেশে বিএনপি ও সমমনাদের ভোট বর্জনের বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জন করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের এই রাজনৈতিক দলটি ভোট বর্জন করে সাধারণ মানুষকে সাত দফা আহ্বানও জানিয়েছে। দলটির মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেছেন, ‘সরকারের প্রহসনের নির্বাচনে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তারা সাধারণ মানুষকে ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করবেন।’
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে কেবল রাঙ্গামাটি আসনে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সমর্থিত প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে ফেলেন। তবে দ্বাদশের ভোট নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য জানায়নি জেএসএস। দলটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার প্রার্থী হলেও পরে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে তার মোবাইল ফোনে কল করলেও রিসিভ করেননি তিনি।
তবে জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এবারের নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত থাকবেন দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। এ কারণে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় মূলত ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ভোট পড়ার হার নগণ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নৌকায় আস্থা রাখল দুই দল
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটে অংশগ্রহণ করে দ্বাদশে এসে দুটি ‘প্রভাবশালী’ আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ ভোটদানে নিরুৎসাহিত করলেও নৌকায় আস্থা রাখল পাহাড়ের অন্য দুটি আঞ্চলিক দল। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ভেঙে গড়ে ওঠা জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ ভেঙে আত্মপ্রকাশ করা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দ্বাদশের ভোটে একাদশের মতো আওয়ামী লীগকেই সমর্থন জানিয়েছে।
ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সভাপতি শ্যামল চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়েছি। আমরা মনে করছি, আওয়ামী লীগ যদি পুনর্নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে তখন পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন ও পাহাড়ের স্থায়ী প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। সেজন্য আমরা নির্বাচনে নৌকাকে সমর্থন জানিয়েছি।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহ-সাধারণ সম্পাদক ও বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব নির্বাচনেই আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন তো থাকেই। এবারের নির্বাচনে আমরা প্রত্যক্ষভাবে নৌকার প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছি।’
৩ জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী ৯ জন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় মোট ৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। খাগড়াছড়িতে চারজন, রাঙ্গামাটিতে তিনজন ও বান্দরবানে দুজন। ২৯৮ নম্বর আসন খাগড়াছড়িতে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী চারজন— আওয়ামী লীগের তিনবারের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির মিথিলা রোয়াজা, সোনালী আঁশ প্রতীকে তৃণমূল বিএনপির উশেপ্রু মারমা এবং আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপল্স পার্টির মোহাম্মদ মোস্তফা।
২৯৯ নম্বর রাঙ্গামাটি আসনে প্রার্থী তিনজন। আওয়ামী লীগের হয়ে চার বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, সোনালী আঁশ প্রতীকে তৃণমূল বিএনপির মো. মিজানুর রহমান এবং ছড়ি (লাঠি) প্রতীকে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দে।
আর ৩০০ নম্বর বান্দরবান আসনে প্রার্থী দুজন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বীর বাহাদুর উশৈসিং ছয়বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি এবার সপ্তমবার প্রার্থী হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির এ টি এম শহিদুল ইসলাম।
ভোটার সাড়ে ১২ লাখ
দুই হাজার ৬৯৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে গঠিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উপজেলা রয়েছে ৯টি। এই নির্বাচনি আসনে মোট ভোটার পাঁচ লাখ ১৫ হাজার ৪১৯ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার দুই লাখ ৫৩ হাজার ৩৭৩ জন, পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৬২ হাজার ৪৪ জন, তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন।
ছয় হাজার ১১৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে গঠিত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় মোট ভোটার চার লাখ ৭৪ হাজার ৩৫৪ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৬, পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৪৭ হাজার ৩১৬ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন।
৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পার্বত্য বান্দরবান জেলা শেষ সংসদীয় আসন। আয়তন চার হাজার ৪৭৩ বর্গ কিলোমিটার। এই উপজেলায় উপজেলা রয়েছে সাতটি। নির্বাচনি এই আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৮৮ হাজার ৩০ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৬ জন, পুরুষ ভোটার এক লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন।
অতিদুর্গম ৩৩ ‘হেলিসর্টি’ ভোটকেন্দ্র
খাগড়াছড়ির ১৯৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দুর্গম এলাকার তিনটি ভোটকেন্দ্র ‘হেলিসর্টি’। অর্থাৎ এই তিনটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনি সরঞ্জাম ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের যেতে হয় হেলিকপ্টারে করে। তিনটি হেলিসর্টি কেন্দ্রের মধ্যে দুটি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায়, একটি দীঘিনালায়।
রাঙ্গামাটির ২১৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দুর্গম এলাকার ১৮টি ভোটকেন্দ্র ‘হেলিসর্টি’— বাঘাইছড়িতে ছয়টি, বরকলে দুটি, জুরাছড়িতে সাতটি এবং বিলাইছড়ি উপজেলায় তিনটি। বান্দরবানের ১৮২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দুর্গম এলাকার ১২টি ভোটকেন্দ্র ‘হেলিসর্টি’। এর মধ্যে রোয়াংছড়িতে একটি, রুমায় তিনটি ও থানচি উপজেলায় আটটি।
বিভিন্ন নির্বাচনি পাহাড়ের এসব হেলিসর্টি কেন্দ্রে নির্বাচনি সরঞ্জাম ও ভোটগ্রহণ কর্মীদের হেলিকপ্টারে করে পাঠানো হলেও প্রায় সময়ই ফিরে আসতে হয় দুর্গম এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে সড়ক পথ ধরেই। তবে এবার রাঙ্গামাটি রির্টানিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ১৮টি হেলিসর্টি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনি সরঞ্জাম ও ভোটগ্রহণ কর্মীদের ৮ জানুয়ারি হেলিকপ্টারে করেই নিয়ে আসা হবে।
সারাবাংলা/টিআর
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি দীপংকর তালুকদার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পার্বত্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য বান্দরবান পার্বত্য রাঙ্গামাটি বান্দরবান বীর বাহাদুর উশৈসিং রাঙ্গামাটি