মেঘে শুরু মাঘ, বৃষ্টির সঙ্গে শৈত্যপ্রবাহেরও আভাস
১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:২৬
ঢাকা: কথায় আছে, মাঘের শীতে বাঘ পালায়। পৌষের শেষ ভাগ থেকে সারাদেশে, বিশেষ করে দেশের উত্তর ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের তাপমাত্রা কমতে কমতে যেখানে এসে ঠেকেছে, তাতে মাঘের শুরুতে সে প্রবাদ খুব একটা মিথ্যা মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অবশ্য বলছে, মাঘের প্রথম দিনে তাপমাত্রা খানিকটা বেড়েছে। এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। তবে সেই মেঘের প্রভাবে রয়েছে বৃষ্টির পূর্বাভাস। বৃষ্টির পর মেঘ কেটে গেলে ফের কমতে পারে তাপমাত্রা। এমনকি মাঘের মাঝামাঝি সময়ে ফের শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনাও রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
ঋতুচক্রের পালাবদলেই আজ সোমবার (১৫ জানুয়ারি) শুরু হয়েছে বঙ্গাব্দ বর্ষপঞ্জির দশম মাস মাঘ। এ মাসেই রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম উৎসব মাঘী পূর্ণিমা। আবার এই মাসেরই শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম উৎসব সরস্বতী পূজা।
আবহাওয়ার তথ্য বলছে, হাড়কাঁপানো শীতকে সঙ্গী করেই এসব উৎসব পালন করতে হবে এ বছর।
গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ক্রমেই কমছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোসহ দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা, যশোর এলাকাতেও তাপমাত্রা ক্রমশই কমেছে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা নেমেছে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে কেবল তাপমাত্রা একটু বেশি। এরমধ্যে সীতাকুণ্ডে রোববার (১৪ জানুয়ারি) সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
রোববারের তুলনায় মাঘের প্রথম দিন সোমবার অবশ্য অনেক এলাকাতেই তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল দিনাজপুরে ৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সোমবার সকালে সেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়েছে ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রংপুর শহরে রোববার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সোমবার সকালে ছিল ১১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের সর্বউত্তরের তেঁতুলিয়ায় রোববারের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৮.৮ ডিগ্রি সেলয়িাস, সোমবার সকালে যা বেড়ে হয়েছে ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজশাহীতেও একদিনের ব্যবধানে ৯.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে হয়েছে ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে তাপমাত্রা কমেছে বরিশালে। রোববার ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে এদিন তাপমাত্রা নেমে এসেছে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ঠাকুগাঁওয়েও রোববারের ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে সোমবার তাপমাত্রা নেমেছে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে, আজ সোমবার ও আগামীকাল মঙ্গলবার সারাদেশে আবহাওয়া মূলত শুষ্ক থাকলেও অস্থায়ীভাবে আকাশ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। একইসময়ে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশেই মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে, যা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। বুধবার খুলনা বিভাগে হালকা বৃষ্টি বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। দেশের অন্য এলাকা অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে।
আকাশে মেঘের কারণেই কারণে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে বলে জানালেন রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক আফরোজা পারভীন। সোমবার সকালে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রংপুর, খুলনা, রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। আজ তাপমাত্রা একটু বেড়েছে। আজ রংপুরে শৈত্যপ্রবাহ নেই। তবে দিনাজপুর, সৈয়দপুর এলাকার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ থাকায় দুয়েকদিন তাপমাত্রা আরেকটু বাড়বে।’
তবে তাপমাত্রা বাড়ার এই খবরও খুব একটা স্বস্তির কারণ হবে না। কারণ বৃষ্টির পূর্বাভাস এবং মাঘের মাঝামাঝি তথা জানুয়ারির শেষের দিকে শৈত্যপ্রবাহের কথাও জানালেন আফরোজা। তিনি বলেন, ‘বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। বৃষ্টি হলে আকাশের মেঘ কেটে যাবে। তখন আবার তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। আর এ মাসের (জানুয়ারি) শেষের দিকে উত্তর ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।’
রাজশাহীতেও গত কয়েকদিন হলো দুপুরের আগে দেখা মিলছে না সূর্যের। সূর্য উঠলেও সূর্যালোকে নেই উত্তাপ। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক হেলেন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত দুদিন রাজশাহীতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। তবে সোমবার তাপমাত্রা বেড়েছে। আকাশ মেঘে ঢেকে থাকার কারণে সূর্যের দেখা মিলছে না। মঙ্গলবার থেকে সূর্যের দেখা মিলতে পারে।’
ঢাকা শহরের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। আবহাওয়া প্রধানত শুস্ক থাকতে পারে। এছাড়া ঘন কুয়াশাও পড়তে পারে। পাশাপাশি উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৬ থেকে ১২ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যেতে পারে।
এদিকে শীতের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে শীতজনিত রোগবালাই। শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশিসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্তদের ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৪০৫ জন, যার অধিকাংশই শিশু। বর্তমানে হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ১২ শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছে ৬৪ শিশু।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালসহ উপজেলা সদর হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকেও শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রামেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শনিবার সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভর্তি হয় ৭২টি শিশু। মেডিসিন ওয়ার্ডেও বৃদ্ধ ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক জানান, এই সময়ে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। চিকিৎসকরা এরকম আবহাওয়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শিশু ও বয়স্কদের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গত ১৫ দিনে দুই হাজার ১৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল সূত্র বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। শিশুরা জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিসে আক্রান্তের হার বেশি তাদের মধ্যে।
এদিকে শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় আগুন ও গরম তরলে দগ্ধ রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এ ধরনের রোগীর মধ্যে বিশেষ করে শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, সেখানে গত জুনে কেবল ইমার্জেন্সিতে বিভিন্নভাবে দগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৩৯ জন, যার মধ্যে ১৮১টি ছিল শিশু। নভেম্বরে ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয় ৭৬৪ জন, যার মধ্যে শিশু ৩৬৫টি। ডিসেম্বরে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এ মাসে চিকিৎসা নেওয়া দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ১২৬ জন, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ৪৬১টি।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক ফারুক আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগুন পোহানোসহ পানি গরম করা বা গরম পানি ব্যবহার করতে গিয়ে রোগীরা দগ্ধ হচ্ছেন। এই মুহূর্তে বার্ন ইউনিটে ১২টি শয্যায় ১১ জন চিকিৎসাধীন। তাদের শরীরের ১০ থেকে ৪৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।’
তীব্র শীতের প্রভাব পড়েছে কৃষিখাতেও। বিশেষ করে আলু ক্ষেত ও বোরো ধানের বীজতলা নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। আলুতে লেটব্লাইটসহ নানা ধরনের রোগবালাই দেখা দিয়েছে। বীজতলাগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আলু উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা জয়পুরহাটেই আলুর ক্ষেতে লেটব্লাইট রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। জেলা সদরের বানিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলমের ৪ বিঘা আলু জমির পুরোটাই লেটব্লাইটে আক্রান্ত। ক্ষেতলাল উপজেলার তালশন গ্রামের কৃষক জামির উদ্দিনের ছয় বিঘা, সমন্তাহার গ্রামের কৃষক মোকাব্বের আলীর দুই বিঘা জমির অবস্থাও একই।
বিভিন্ন এলাকায় তীব্র শীত ও কুয়াশায় বোরের বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে বীজতলার চারা হলুদ ও কিছুটা কালচে হতে শুরু করছে। বগুড়ার শেখেরকোলা নুরইল দক্ষিণ পাড়ার কৃষক আব্দুল কুদ্দুস চার বিঘা জমির জন্য বোরের বীজতলা করেছিলেন। সেই বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক আব্দুল মতিনও সারাবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে কুয়াশা থাকলে বোরো রোপণ করা সম্ভব হবে না।’
এ পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় বোরো বীজতলায় তিন থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে বলেছে। ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা ও চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে এবং বীজতলা থেকে সকালে পানি বের করে দিয়ে নতুন পানি দিতে বললা হয়েছে কৃষকদের।
আলুর লেটব্লাইট রোগ প্রতিরোধে ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে বলেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সরিষায় অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ইপ্রোডিয়ন গোত্রের ছত্রাকনাশক দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ফল গাছে নিয়মিত হালকা সেচ দিতে এবং কচি ফল গাছ ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে রক্ষার জন্য খড় বা পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে শীতের এই প্রকোপেও ফলনে খুব প্রভাব পড়বে না বলে আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এনামুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৈরি আবহাওয়ায় আলু ক্ষেতে মড়ক দেখা দিয়েছে। কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি ফলনে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
কৃষকরা পরামর্শ মেনে চললে বোরো বীজতলারও তেমন ক্ষতি হবে না বলে আশাবাদ জানালেন বগুড়া কৃষি অধিদফতরের উপপরিচালক মো. মতলুবর রহমান।
সারাবাংলা/টিআর/এমও