মিটার-ট্রান্সফরমার চুরি করে চিরকুটে টাকা দাবি, উদ্বিগ্ন কৃষক
১৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫২
বগুড়া: বোরোর সেচ মৌসুম পুরোদমে শুরু হতে এখনো কিছুদিন বাকি। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য ইতোমধ্যে বোরোর আবাদ শুরু হয়েছে। সেচনির্ভর এই ফসলের পুরো আবাদ শুরু হবে আর কিছুদিনের মধ্যেই। তবে সেচ মৌসুম শুরুর আগেই মিটার ও ট্রান্সফরমার চুরি নিয়ে বগুড়ার অনেক এলাকার কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ, জেলার বিভিন্ন এলাকায় বোরো স্কিম চালুর আগেই গভীর নলকূপের মিটার ও বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি হয়ে যাচ্ছে। যদিও এই চুরি চলে বছর জুড়ে। কিন্তু বোরো মৌসুমে তা বেড়ে যায়।
এদিকে মিটার চুরির পর দুর্বৃত্তরা টাকা পাঠানোর জন্য চিরকুটে নম্বর রেখে যাচ্ছে। সেই নম্বরে টাকা পাঠালে তবেই মিলছে মিটার। আবার টাকা পাঠিয়েও মিটার পাননি এমন কয়েকজন কৃষকও রয়েছেন। একইভাবে চুরি করা হচ্ছে ট্রান্সফরমারও। শুধুমাত্র বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন সংযোগেই গত একবছরে চার শতাধিক ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সেচ সংযোগের মিটার চুরির সঠিক তথ্য দিতে না পারলেও তারা বলছেন, প্রতিমাসেই সব এলাকা থেকেই মিটার চুরি হচ্ছে।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার দামুয়াপাড়া গ্রামের জয়শংকরের গভীর নলকূপের ৪৫ বিঘার স্কিম রয়েছে। নিজের রয়েছে এক একর জমি। স্কিম চালুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই মিটার চুরি করে দুর্বৃত্তরা। তারা পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে চিরকুটে মোবাইল নম্বর দিয়ে যায়। বিকাশ বা নগদে সেই টাকা পরিশোধের নির্দেশনা থাকে। জয়শংকর তার চুরি যাওয়া মিটার ফেরত পেতে দুই হাজার টাকা দিলেও মিটার পাননি। পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করলে তারা নতুন মিটার নেওয়ার পরামর্শ দেন। জয়শঙ্করের হাতে এখন মিটার কেনার টাকা না থাকায় পড়েছেন বিপাকে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা যায়, নন্দীগ্রামে এক রাতেই চারটি মিটার চুরির খবর জানিয়েছেন গ্রাহকরা। জেলার মধ্যে মিটার ও ট্রান্সফরমার চুরির শীর্ষে থাকা বগুড়া পল্লী বিদ্যুতের দুপচাঁচিয়া জোনের আওতাধীন গ্রাহক নীলাহালি গ্রামের মোখালেছুর রহমান জানান, তিনি গভীর নলকূপ সংযোগের ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরির আশঙ্কায় আতঙ্কে থাকেন সবসময়। এ বছর সেচ মৌসুমে কী হবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, গত বছরে তার স্কিমের গভীর নলকূপের ট্রান্সফরমার চুরি হয়। প্রথমবার চুরির পর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ট্রান্সফরমার লাগিয়েছেন। সেজন্য এবার তিনি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কারণ, এবার চুরি হলে ট্রান্সফরমার কিনতে তার লাগবে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বোরো মৌসুম ও পরে অর্থাৎ একই বছরে তার মিটারও চুরি হয়েছে। সেক্ষেত্রেও তাকে মিটার কিনতে হয়েছে। শুধু মিটার চুরি করে টাকার বিনিময়ে ফেরত নয়, অনেক এলাকায় কৃষকদের সঙ্গে দুর্বৃত্তরা বছরব্যাপী চুক্তি করছে। নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিলে তারা কৃষকের সেচ সংযোগের মিটার ও ট্রান্সফরমার চুরি করবে না। কিন্তু টাকা দিয়েও প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা।
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেন। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া জোনের এক কর্মকর্তা জানান, তার এলাকাতে দিনে সাত/আটটি মিটার চুরি হচ্ছে। এবং মিটারের মুক্তিপণ হিসেবে টাকা দাবি করছে চোররা। একেকটি মিটার বাবদ তিন থেকে আট হাজার টাকা চাচ্ছে। কৃষকরা টাকা দিলে চুরি হওয়া মিটার ফেরত দিচ্ছে। কৃষকরা জানান, মোবাইলে বিকাশ বা নগদে টাকা দেওয়ার পর নির্দিষ্ট স্থানে মিটার ফেলে রাখে বা লুকিয়ে রেখে জানিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
বগুড়া পল্লী বিদ্যু সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে ৪০৫টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ বিভাগ-১ এর অধীনে ছয়টি উপজেলায় সাধারণ ও সেচ মিলিয়ে চুরি হওয়া ট্রান্সফরমারের সংখ্যা ২৯৯টি। একই সময় পল্লী বিদ্যুত সমিতি-২ এর আওতাধীন এলাকা থেকে চুরি হয়েছে ১০৬টি ট্রান্সফরমার। পল্লী বিদ্যুত সমিতি কর্মকর্তারা জানান, ট্রান্সফরমার চুরি হলে প্রথমবার গ্রাহককে অর্ধেক টাকা দিতে হয়ে। দ্বিতীয় বার হলে একই নিয়ম আর থাকে না। এক্ষেত্রে গ্রাহককেই ক্ষতির বোঝা নিতে হয়।
মিটার, ট্রান্সফরমার চুরি ও ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (১) জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, বগুড়ার নন্দীগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজমগীর হোসাইন জানান, তারা কাহালু উপজেলা থেকে একটি চক্রের প্রধানকে আটক করেছেন। এই চক্র জেলার বিভিন্নস্থানে মিটার চুরি ও কৃষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে আসছিল। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-রিচালক মো. মতলবুর রহমান জানান, উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি আলোচনার জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সারাবাংলা/পিটিএম