জনশক্তি রফতানিতে পেছালেও রেমিট্যান্সে রেকর্ডের পথে চট্টগ্রাম
১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:২৭
চটগ্রাম ব্যুরো: সদ্যবিদায়ী বছরে জনশক্তি রফতানিতে বাংলাদেশ রেকর্ড গড়লেও কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার ৭১৫ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিন হাজার ৩৯ জন কম। অথচ বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে একসময় এ জেলাই পথ দেখিয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ভিসা বন্ধ করে দেওয়ায় জনশক্তি রফতানিতে কিছুটা ধীরগতি তৈরি হয়েছে। তবে প্রবাসী আয়ে চট্টগ্রাম এখনো আগের মতোই এগিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যে রেমিট্যান্স এসেছে, সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণে নতুন রেকর্ড হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৫৯৫ জন নারী। এর অর্ধেকের বেশি গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
২০২২ সালে চট্টগ্রাম থেকে বিদেশগামী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৬৮ হাজার ৭৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৭ হাজার ৯৪৭ জন, নারী ৮০৭ জন। ২০২১ সালে বিদেশগামীর মধ্যে ছিলেন ২৪ হাজার ৬১৭ জন পুরুষ, ৫০৭ জন নারী।
গত নভেম্বরে কাতার বাংলাদেশি কর্মীদের নতুন করে ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর নভেম্বর-ডিসেম্বর দুমাসে নতুনভাবে কেউ ওই দেশে যেতে পারেননি। প্রবাসীরা অবশ্য এজন্য দেশীয় এজেন্সিগুলোকে দুষছেন।
১৫ দিন আগে কাতার থেকে দেশে আসেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা মো. মানিক। ভিসা বন্ধের বিষয়ে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাতারে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার কোটা শেষ। তারা কোটা আর বাড়াচ্ছে না। এখানে কিছু দালাল আর এজেন্সি আছে। তারা ১০টা ওয়ার্ক পারমিট পেলে ২০-৩০ জন কিংবা তারও বেশি মানুষকে কাতারে পাঠানোর কথা বলে প্রতারণা করে। সাধারণ মানুষকে ট্যুরিস্ট ভিসা ধরিয়ে দিয়ে প্রতারণা করে।’
‘সেই ভিসা নিয়ে অনেকে কাতারে যান, কিন্তু কাজ পান না। গোপনে থেকে গিয়ে অনেকে কাজ নেন। কিন্তু ধরা পড়লে পুলিশ তাদের দেশে পাঠিয়ে দেন। এ ধরনের ঝামেলার জন্য কাতার এখন বাংলাদেশিদের কোটা আর বাড়াতে আগ্রহী নয় বলে আমরা শুনেছি। তবে আমাদের মধ্যে যাদের ওয়ার্ক পারমিট অনুযায়ী ভিসার মেয়াদ এখনো আছে, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না,’— বলেন মো. মানিক।
করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে ২০২২ সালে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছিল। ২০২৩ সালেও সেই অগ্রগতির ধারা বজায় থাকলেও চট্টগ্রাম কিছুটা পিছিয়ে পড়ার কারণ খতিয়ে দেখছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে জেলা থেকে বেশি কর্মী যায় মধ্যপ্রাচ্যে। গন্তব্য প্রধানত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, মালয়েশিয়া ও কাতার। গত বছর কাতারে ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মী যাওয়া কিছুটা কমেছে। এর পেছনে আর কোনো কারণ আমরা দেখছি না।’
বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রত্যাশীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক বশির আহম্মদ মনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এলাকা হিসেবে চট্টগ্রাম খুবই রাজনীতিপ্রবণ। এখানে রাজনীতি, নির্বাচন এসবের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি। বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। বিদেশে থাকলেও অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। অনেকের স্বজন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এজন্য অনেকে দেশে ফিরেছেন, অনেকে আবার তাদের বিদেশযাত্রা পিছিয়ে দিয়ে নির্বাচনটা পার করেছেন। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভিসানীতিতে অঘোষিত ধীরগতিরও একটা প্রভাব পড়েছে।’
জানা গেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৮৬ জন কর্মী চাকরি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক লোক গেছেন সৌদি আরব। এরপরের অবস্থান ওমান। তারপর সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ থেকে চার লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন সৌদি আরবে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯০ হাজার ৭৮ জন, কুয়েতে ৩৪ হাজার ৪৮৯ জন, ওমানে এক লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ জন, কাতারে ৫০ হাজার ৪১৪ জন ও মালয়েশিয়ায় তিন লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ জন গেছেন।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে গেছেন ৬৫ হাজার ৭১৫ জন। তাদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে গেছেন ছয় হাজার ১০৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজার ৪০৬ জন, মার্চে ছয় হাজার ১০৪ জন, এপ্রিলে তিন হাজার ৮২৫ জন, মে মাসে চার হাজার ৮৯৩ জন, জুনে চার হাজার ৪৫০ জন, জুলাইয়ে পাঁচ হাজার ৭৫৬ জন, আগস্টে সাত হাজার ৪২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ছয় হাজার ১১০ জন, অক্টোবরে পাঁচ হাজার ৩০৮ জন, নভেম্বরে পাঁচ হাজার ২২২ জন এবং ডিসেম্বরে গেছেন পাঁচ হাজার ৬০৫ জন।
রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়েনি
জনশক্তি রফতানি কিছুটা কমলেও ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বা রেমিট্যান্সে তেমন প্রভাব পড়েনি। সব ঠিক থাকলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চট্টগ্রামে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে জুলাই মাসে ১৮০ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আগস্টে ১১৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ১১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, অক্টোবরে ১৮২ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, নভেম্বরে ২০৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার ও ডিসেম্বরে ২৩০ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন চট্টগ্রামের প্রবাসীরা।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রামের প্রবাসীরা এক হাজার ৬১১ মিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ২১৮ মিলিয়ন ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে এক হাজার ৩৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স আগের তিন অর্থবছরের অর্ধেক সময়ে দেশে আসা রেমিট্যান্সের তুলনায় অনেক বেশি।
বিএমইটির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম প্রথম ছয় মাসেই গত অর্থবছরের রেমিট্যান্সের ৬৩ শতাংশ পূর্ণ করে ফেলেছে। আর ছয় মাস বাকি আছে। আশা করছি, এবার গত অর্থবছরকেও ছাড়িয়ে যাবে।’
সারাদেশের হিসাব বলছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১০ হাজার ৭৯৮ মিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ হাজার ৬১০ মিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ হাজার ৩১ মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের রেমিট্যান্স গত অর্থবছরে দেশে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় অর্ধেকই।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/টিআর
চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম থেকে জনশক্তি রফতানি চট্টগ্রামে রেমিট্যান্স জনশক্তি রফতানি রেমিট্যান্স শ্রমবাজার