Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আইডি কার্ডে নাম সবু রাণী দে, সবাই ডাকে হাত কাটা সবু’

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২০ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:১৭

কক্সবাজার: ‘সেদিন বিকেলে খুব বৃষ্টি ছিল। মাতাল অবস্থায় আমার স্বামী ঘরে ফেরে। এরপর কোনো কারণ ছাড়াই মারধর শুরু করে। নেশা করলেই সে অত্যাচার করত। কিন্তু ওই দিন সে খুবই ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আমাকে মারতে মারতে হাত-পা বেঁধে গলায় ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমি মাটিতে পড়ে যাই। দুই হাত বাঁধা ছিল। তখন সে হাত দুটি গাছের ওপর রেখে কুপিয়ে কুপিয়ে কবজি থেকে বিচ্ছিন্ন করে। সেই মুহূর্তের যন্ত্রণা এখনো ভুলতে পারি না।’

‘আমি চিৎকার করছিলাম বাঁচার জন্য। হয়তো বৃষ্টির কারণে লোকজন শুনতে পায়নি। হাতকাটা অবস্থায় গড়াতে গড়াতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। এর পর জ্ঞান হারাই। তারপর কিছু আর মনে নেই। রাতে জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি মেডিকেলে ভর্তি। দুই হাতে ব্যান্ডেজ। কিন্তু কবজি থেকে হাত দুইটা নেই। মাসখানেক মেডিকেলে থাকতে হয়েছে।’

এভাবেই ২৪ বছর আগে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সবু রাণী দে। কক্সবাজার সদর উপজেলা খুরুশকুল দক্ষিণ হিন্দু পাড়ার প্রয়াত লক্ষ্মী চরণ দে’র স্ত্রী। স্বামী লক্ষ্মী চরণ-ই তার হাত দুটি কেটে ফেলেছিলেন। দিনটি ছিল ২০০১ সালের ১৯ জুন, ১৪০৮ বঙ্গাব্দের ৪ আষাঢ়। ওই ঘটনার পর লোকজন ধরে লক্ষ্মী চরণকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পরে স্ত্রীর হাত কাটার অপরাধে ১২ বছর জেল খাটেন তিনি।

সবু রাণী বলতে থাকেন, ‘আমার চার সন্তান। দুই মেয়ে দুই ছেলে। ওই সময় বড় মেয়ের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। একদিকে মাকে ছাড়া বাচ্চাদের কান্না, অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনসহ আত্মীয়-স্বজনের অবহেলা। সবমিলিয়ে কাটা হাত শুকানোর আগেই মেডিকেল ছাড়তে হয় আমাকে। এরপর হাতছাড়া নতুন যুদ্ধ শুরু। একে একে সব আত্মীয়-স্বজন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। চার সন্তান লালন-পালন আর তাদের খাওয়া-পড়া নিয়ে খুবই কষ্টে পড়ে যাই। পরে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করেছি পাড়ায় পাড়ায়। সেই দিনগুলো মনে পড়লে এখনো চিৎকার করে কান্না আসে।’

সন্তানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবু রাণী বলেন, ‘মানুষ মা-বাবার কাছে ঋণী হয়, কিন্তু আমি ঋণী সন্তানদের কাছে। তারা না থাকলে হয়তো এতদিন বাঁচতে পারতাম না। ওই সময় আমার ছয় বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে রান্না করত। পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখিয়ে দিতাম। ছোট্ট ছেলেটি আমার মাথা আঁচড়ে দিত। তারাই আমাকে খাইয়ে দিত, গোসল করিয়ে দিত এবং পরিষ্কার করে দিত। আজও তাদের হাতেই পালিত। আমার দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেদের ছোট্ট একটি দোকান আছে, যা দিয়ে কোনোভাবে জীবন চলে। জানি না সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে। এমন কষ্ট যেন কোনো শত্রুরও না হয়।’

স্বামী লক্ষ্মী চরণের কী অবস্থা হয়েছিল— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনায় সাজা হওয়ায় সে প্রায় ১২ বছর জেলে ছিল। জেলে থাকা অবস্থায় আমি বেশ কয়েকবার খাবার নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে তার জামিনের জন্য সহযোগিতা করেছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো জেল থেকে বের হয়ে সে আমাকে আমাকে ফের গ্রহণ করবে। কিন্তু না, জেল থেকে বের হয়েই আগের মতো অত্যাচার শুরু করে সে। সব সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়।’

সবু রাণী বলতে থাকেন, ‘এমনকি শ্বশুর বাড়ির লোকজন মিলে আমার বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকার মামলা দেয়। তারা আমাকে খুবই ঘৃণার চোখে দেখত। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর খবর আসে সে খুব অসুস্থ। তাকে ডিজিটাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু গিয়ে দেখি সে মারা গেছে। তখন তার সব আত্মীয়-স্বজন তাকে ফেলে চলে যায়। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে স্বামীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করি।’

এত কষ্টের মাঝেও কিছু কি চাওয়ার আছে?— এমন প্রশ্নের উত্তরে সবু বলেন, ‘কী আর চাইব, যাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই আমার হাত দুটি কেটে ফেলেছে! এরপরও সংসার করতে চেয়েছি তার সঙ্গে। কিন্তু তাও হলো না। এর মধ্যে পাল্টে গেছে আমার নাম। শুধু আইডি কার্ডে লেখা আছে সবু রাণী দে। কিন্তু সবাই আমাকে ডাকে হাত কাটা সবু বলে। কষ্ট লাগে নামটা শুনলেই। কোথাও যেতে পারি না। যেতে চাইও না। নিজেকে লুকিয়ে রাখি। খুবই ইচ্ছে হয়, যদি দুটি হাত থাকত। আসল হাত তো আর পাব না, যদি কৃত্রিম দুটি হাত পেতাম, তাহলে মানুষের সামনে যেতাম।’

সারাবাংলা/পিটিএম

কাট হাত দু’হাত সবু রাণী দে


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর