দোকান-পার্কিং-আস্তাবল— অবশেষে ফ্লাইওভারের নিচে নজর ডিএসসিসির
২০ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:২৭
ঢাকা: ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সংকট জায়গা। ইট-কংক্রিটের এই মহানগরে নেই পর্যাপ্ত সড়ক, ফুটপাত, পার্ক, হাঁটা বা বসার জায়গা কিংবা পাবলিক টয়লেট। সড়কের সংকট আর এর প্রভাবে তীব্র যানজটের হাত থেকে মুক্তি পেতে রাজধানীজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার। সেসব ফ্লাইওভারের ওপরের অংশ বহুল ব্যবহৃত হলেও এর নিচের অংশগুলো চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টাই করেনি। ফলে জায়গাগুলো শুরু থেকেই পড়ে রয়েছে অব্যবহৃত অবস্থায়। এই সুযোগে রাজধানীজুড়ে ফ্লাইওভারের নিচে কোথাও দেখা যায় আবর্জনার স্তূপ, কোনো কোনো জায়গায় তৈরি হয়েছে ভ্যান-রিকশার পার্কিং, আবার কোনো কোনো জায়গা পরিণত হয়েছে খোলা টয়লেটে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি, অব্যবহৃত জায়গাগুলো কাজে লাগুক। এর আগে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই এসব জায়গা কাজে লাগানোর ঘোষণা দিলেও দিন শেষে তা বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারেনি। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাগুলো নিয়ে এতদিনের সেই অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ডিএসসিসি বলছে, এই জায়গাগুলোকেও লাগানো হবে কাজে।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আটটি সেগমেন্টে ভাগ করে কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে সৌন্দর্যবর্ধন, মিডিয়ান তৈরি, পথচারী চলাচলের জায়গা, লাইটিং, পার্কিং, বিনোদনের ব্যবস্থা, বাগান ইত্যাদি।’
এই কাজ কবে শুরু হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ জানাতে পারেননি মিজানুর রহমান। তবে যত দ্রুতসম্ভব কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার এই সিটি করপোরেশনের অধীনে ফ্লাইওভার মোট প্রায় ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। খিলগাঁও ফ্লাইওভার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, রামপুরা-মগবাজার ও মালিবাগ ফ্লাইওভারের অনেকটা অংশ এই সিটির অধীন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এসব ফ্লাইওভারের নিচের এলাকাগুলোর দশা বেহাল।
রাজধানী ঢাকা তথা দেশেরই প্রথম ফ্লাইওভারটি তৈরি হয় খিলগাঁওয়ে। এই ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা যে যার ইচ্ছামতো ব্যবহার করছে। এক দশমিক ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়ালসড়কটি খিলগাঁও, মালিবাগ ও রাজারবাগকে সংযুক্ত করেছে। এই ফ্লাইওভারের রাজারবাগ থেকে খিলগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে অসংখ্য আসবাবপত্রের দোকান। অনেক দোকানই নিজেদের নতুন ও পুরনো আসবাবপত্র সাজিয়ে রেখেছে ফ্লাইওভারের নিচের অংশে। এর আকেটি বড় অংশ ময়লা-আবর্জনার দখলে।
একই ফ্লাইওভারের খিলগাঁও রেলগেট থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়ার অংশে বানানো হয়েছে সিটি করপোরেশনের ময়লা সংগ্রহের সেকেন্ডারি স্টেশন বা এসটিএস। এখানে জড়ো হওয়া বর্জ্যের বিকট দুর্গন্ধের পাশাপাশি ময়লার গাড়ি ও ট্র্যাকের চলাচল এই এলাকার জনভোগান্তির বড় কারণ। এর বাইরেও এই ফ্লাইওভারের নিজের আরও কিছু অংশ পরিণত হয়েছে ভাসমান মানুষের বসবাসের জায়গায়। এসব জায়গায় পুরনো তোশক থেকে শুরু করে ভাঙারির জিনিসপত্রও স্তূপ করে রাখা।
কাছেই আরেকটি ফ্লাইওভারের মালিবাগ-মগবাজার, আবুল হোটেল-শান্তিনগর অংশটি পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এই ফ্লাইওভারের মগবাজার অংশটি আবার উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীনে। ওই অংশটিতে ফ্লাইওভারের স্প্যানে ও নিচের অংশে চিত্রাঙ্কন করেছে ডিএনসিসি। নিচের অংশ ঘিরে গাছও লাগিয়েছে। কিন্তু উদ্যোগের অভাব আর অব্যবস্থাপনায় নষ্ট হচ্ছে দক্ষিণ সিটির অংশটুকু।
এই অংশের ফ্লাইওভার মূলত ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ পার্কিংয়ে। আশপাশে মার্কেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে ভ্যান, রিকশা ও মিনি ট্রাক পার্ক করে রাখা হয় এসব স্থানে। মৌচাক থেকে রাজারবাগ পর্যন্ত অংশে গাড়ি পার্কিং বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া পুলিশ বক্সও রয়েছে ফ্লাইওভারের নিচে। মালিবাগ থেকে শান্তিনগর অংশের নিচের জায়গাটুকু অবৈধ কার পার্কিং, আবর্জনা সংগ্রহের ভ্যান ও জমে থাকা ময়লার দখলে।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দেশের সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার। দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭০ কিলোমিটার। এটি আকারে যেমন বড়, এর নিচের অংশটিও তেমনটি আরও বেশি অব্যবস্থাপনার শিকার। যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তানের মতো ব্যস্ত এলাকার এই ফ্লাইওভারের নিচের অংশের অবস্থাও করুণ। অন্যান্য ফ্লাইওভারের মতোই এর নিচের অংশেও রয়েছে ভাসমান মানুষের বসবাস, অবৈধ পার্কিং আর আবর্জনার স্তূপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাঙাচোরা রাস্তার দুর্ভোগ।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ অংশের নিচে সড়কের দুর্ভোগে নাকাল এলাকাবাসী ও পথচারী। পাশেই মাছবাজার। সেখানকার দুর্গন্ধ তো আছেই, অধিকাংশ সময়ই কাঁদা-পানি ও খানাখন্দে ভরা এই সড়ক তৈরি করছে চরম দুর্ভোগ। এ ছাড়া গুলিস্তান অংশে ঘোড়ার গাড়িগুলো ফ্লাইওভারের নিচে জড়ো করে রাখায় সেখানকার অবস্থাও অসহনীয়। ঘোড়ার মল-মূত্র রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।
সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব অব্যবস্থাপনা দূর করতেই স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ফ্লাইওভারের নিচে। সবকিছু নির্মাণের পর এসব জায়গায় পুলিশ বক্সও থাকবে না।
ফ্লাইওভারের পিলার ও নিচে পোস্টার-ব্যানারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মিজানুর রহমান বলেন, আমরা পোস্টার-ব্যানারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাই। এগুলো পরিষ্কার করি। তারপরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এগুলো দ্রুতই সমাধান করা হবে। আশা করি, ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায়গুলো কাজে লাগানো হলে এগুলোর দৌরাত্ম্য কমে আসবে।
এদিকে ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা কাজে লাগাতে ডিএসসিসির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তবে সিটি করপোরেশন যেটিই করুক, পরিকল্পিতভাবে যেন করে, সে আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ মেহেদী আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও অপরিকল্পিত নগরে ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা কাজে লাগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ সিটি এই জায়গাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে থাকলে তাকে সাধুবাদ জানাই। তবে আশা করব, তারা হুট করেই নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েই কিছু করবে না। দীর্ঘদিন ধরে জায়গাগুলো নোংরা পড়ে রয়েছে অথবা অবৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দীর্ঘ জায়গাজুড়ে ফ্লাইওভারের অবস্থান। তাই অবশ্যই সেসব এলাকার বাসিন্দা, দোকানদার, হকার, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া উচিত। তা না করলে জায়াগটি কার্যকরভাবে ব্যবহৃত না হয়ে সড়ক বিভাজকে বিদেশি গাছ লাগানোর মতো হয়ে যাবে।
ফ্লাইওভারের নিচে সিটি করপোরেশনের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) ও পাবলিক টয়লেট বানানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেহেদী আহসান বলেন, ঢাকায় তো এমনিতেই স্থান সংকট। তাই এসব জায়গায় এসটিএস বা পাবলিক টয়লেট বানালে অসুবিধা নেই। তবে অবশ্যই সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, যেন আবর্জনা রাস্তায় না আসে বা দুর্গন্ধ না হয়।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
ডিএসসিসি ঢাকা দক্ষিণ সিটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ফ্লাইওভার ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা বিআইপি