সার্ভেয়ার স্বামীর আয় বৈধ করতে গৃহিণী স্ত্রী সাজলেন ব্যবসায়ী
২২ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:২৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্বামী সরকারি কর্মকর্তা। আর স্ত্রী পুরোদস্তুর গৃহিণী। কর্মকালীন সময়ে স্বামীর অবৈধভাবে অর্জন করা সম্পদ বৈধ দেখাতে ব্যবসায়ী সাজেন গৃহিণী স্ত্রী। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়েছেন দুজনই। আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৮২১ টাকা সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৬০ লাখ ৯১ হাজার ৭৭১ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে রোববার (২১ জানুয়ারি) দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপসহকারী পরিচালক খাইরুল ইসলাম ভূঁইয়া চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলাটি করেন।
মামলার আসামিরা হলেন— সুনীল কান্তি দেব মহাজন (৫৯) ও তার স্ত্রী স্মৃতি রাণী দেব (৫৫)। সুনীল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সার্ভেয়ার ছিলেন। ২০২০ সালে তিনি অবসরে যান। এ দম্পতি নগরের জামালখান ওয়ার্ডের হেমসেন লেইন এলাকার বাসিন্দা।
দুদকের মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৯ সালে আসামি সুনিল কান্তি দেব মহাজনের বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সময় তার স্ত্রী স্মৃতি রানী দেবের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর স্মৃতি রানী দেবের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেয় দুদক। সেই নোটিশ গ্রহণের প্রায় একমাস পর ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য ১৫ দিন সময় বাড়তি চেয়ে আবেদন করলে কমিশন অনুমোদন দেয়। এরপর একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি তার সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন।
সম্পদ বিবরণীতে সুনীল কান্তি দেব মহাজনের স্ত্রী স্মৃতি রাণী দেব তার নামে থাকা ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা স্থাবর সম্পদ এবং ২০ লাখ ৫৮ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৮৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। তিনি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক জামালখান শাখায় তার নিজ নামের অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৮২১ টাকার তথ্য গোপন করেন, যা ধরা পড়ে তার সম্পদ বিবরণী যাচাইয়ের সময়।
এ ছাড়া স্মৃতি রানী বিভিন্ন সময়ে আয়কর দিলেও সেখানে নিজেকে একজন মৌসুমী ব্যবসায়ী দাবি করেছেন। অথচ সিটি করপোরেশন কিংবা অন্য কোথাও তার নামীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো সনদপত্র নেই। এমনকি তিনি কোনো বিল বা ভাউচারও দেখাতে পারেননি।
স্মৃতি রাণী ১৯৯৪ সালে বিয়ের সময় ১৫২ ভরি সোনা উপহার পেয়েছেন এবং তা ওই বছরই বিক্রি করে দিয়েছেন। বিক্রি থেকে তার আয় হয়েছিল আট লাখ ৮২ হাজার টাকা। এ ছাড়াও তিনি ২০১১ সালে ৩৮ ভরি সোনা বিক্রি করেন, যা থেকে আয় হয় ১৫ লাখ টাকা। অথচ বিয়ের সময়ে পাওয়া সোনা বিক্রি করে দেওয়ায় তার কাছে এত বেশি সোনা থাকা অস্বাভাবিক।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, স্মৃতি রাণী ২০১৪ সালে তার মেয়ের স্বামীকে ১৫ লাখ টাকা ব্যবসার মূলধন হিসেবে দিয়েছিলেন এবং তার কাছ থেকে প্রতি মাসে ১৫ হাজার পেতেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি তার মেয়ের স্বামী রুপন কান্তি দাশও তার আয়কর নথিতে এ দায়ের কথা উল্লেখ করেননি। এ ছাড়াও পোস্ট অফিসে সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকসহ বেশকিছু সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন তিনি।
সম্পদ বিবরণীতে স্মৃতি রাণী দেব ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের মধ্যে কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জে তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ জমিতে দুই তলা ভবন এবং তার ওপরে সেমিপাকা ঘর কেনার কথা উল্লেখ করেন, যার মূল্য ৬৭ লাখ পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা।
দুদকের উপসহকারী পরিচালক খাইরুল ইসলাম ভূঁইয়া সারাবাংলাকে জানান, স্মৃতি রাণী দেব নিজেকে একজন ‘মৌসুমী ব্যবসায়ী’ হিসেবে তার বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে— তিনি মূলত একজন গৃহিণী। আয়কর নথিতে ঘোষিত কমিশন ও মৌসুমী ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো দায়-দেনা, মুনাফা, লেনদেনের রেজিস্ট্রার বা বিল-ভাউচার সংশ্লিষ্ট কোনো দলিল দুদকের অনুসন্ধানে উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। এমনকি তার নামে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত নেই।
খাইরুল বলেন, স্মৃতি তার সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন, ব্যয়সহ তার নিট সম্পদের পরিমাণ এক কোটি ১৩ লাখ ৮২১ টাকা। এর মধ্যে দুদক গ্রহণযোগ্য আয় পেয়েছে ৫২ লাখ ২২ হাজার টাকা, যার মধ্যে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আছে ৬০ লাখ ৯১ হাজার ৭৭১ টাকা। আবার সম্পদ বিবরণীতে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন, যা দুদক আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারার লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একইসঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করে তা ভোগ দখলে রাখায় দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় অপরাধ করেছেন তিনি।
সারাবাংলা/আইসি/টিআর
দুদক দুদকে মালা সার্ভেয়ার সুনীল সুনীল কান্তি দেব মহাজন স্মৃতি রাণী দেব