Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চুয়াডাঙ্গার ৪ উপজেলায় প্রণোদনায় বেড়েছে সরিষার আবাদ

রিফাত রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১১

চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলার মধ্যে দুই উপজেলায় সরিষার আবাদ বেড়ছে ব্যাপকভাবে। ছবি: সারাবাংলা

চুয়াডাঙ্গা: ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কৃষক পর্যায়ে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। সেই প্রণোদনা সুবিধা পাচ্ছেন চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলার কৃষকরাও। তাতে গত পাঁচ অর্থবছরে সরিষার আবাদ বেড়েছে এই জেলায়। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলায় আবাদ না বাড়লেও বিপরীত চিত্র আলমডাঙ্গা ও জীবননগর উপজেলায়। বিশেষ করে আলমডাঙ্গায় পাঁচ বছরের ব্যবধানে সরিষার আবাদ বেড়েছে ৪০ শতাংশ জমিতে। বাকি তিন উপজেলার তুলনায় এই উপজেলায় সরিষার আবাদও ছয় থেকে আট গুণ বেশি জমিতে।

বিজ্ঞাপন

কৃষকরা বলছেন, আমন ধান কাটার পর বোরো ধান রোপণের আগে কৃষকরা তাদের জমিতে সরিষার আবাদ করছেন। ভালো ফলনের পাশাপাশি সরকারি প্রণোদনা পাওয়ায় এই ফসলের আবাদ তাদের জন্য লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি মৌসুমেও তারা ভালো ফলনের প্রত্যাশা করছেন। সরিষার আবাদ বাড়াতে আরও বেশিসংখ্যক কৃষককে প্রণোদনার আওতায় আনার পাশাপাশি প্রণোদনার পরিমাণও বাড়ানোর দাবি কৃষকদের।

চুয়াডাঙ্গায় সরিষার আবাদ ও প্রণোদনা

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩৫০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় এক হাজার ৭৭৫ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ৪০০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৩১১ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল।

ওই অর্থবছরে সদর উপজেলায় দুই লাখ ২৮ হাজার ৫৭০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন ২৮৫ জন কৃষক, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার ৩৪০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন দুই হাজার ১৭০ জন, দামুড়হুদা উপজেলায় এক লাখ ৪৯ হাজার ১৬০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন ২২০ জন এবং জীবননগর উপজেলায় দুই লাখ ২০ হাজার ৩৫০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন ৩২৫ জন কৃষক।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ১৯০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় এক হাজার ৫৬৫ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ৩০২ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ২০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল।

এ অর্থবছরে এক লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন সদর উপজেলায় ৪০০ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২০০ জন প্রণোদনা পেয়েছিলেন ৮৮ হাজার ৪০০ টাকা, দামুড়হুদা উপজেলায় ২০০ জন প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন ৭১ হাজার ৬০০ টাকা ও জীবননগর উপজেলায় ২০০ জন কৃষক প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন ৭১ হাজার ৬০০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

২০২১-২০২২ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ১৬০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় এক হাজার ৬০৫ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ২৫০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৩৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল।

এ মৌসুমে সদর উপজেলার ১৭০ জন কৃষক প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন ৬৭ হাজার ৩৬০ টাকা, আলমডাঙ্গা উপজেলার এক হাজার ৩৯০ জন কৃষক প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪০ টাকা, দামুড়হুদা উপজেলার ২৭০ জন কৃষক প্রণোদনা সুবিধা পান ৯৯ হাজার ৯০০ টাকা ও জীবননগর উপজেলায় ১৭০ জন কৃষক প্রণোদনা সুবিধা পান ৬২ হাজার ৯০০ টাকা।

২০২২-২০২৩ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ২৭৮ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় দুই হাজার ১৫০ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ৩৫৭ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল।

ওই সময় সদর উপজেলার ৭৪০ জন কৃষক দুই লাখ ৯৬ হাজার টাকা, আলমডাঙ্গা উপজেলার সাত হাজার ৩৫০ জন কৃষক ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা, দামুড়হুদা উপজেলার এক হাজার ১৬০ জন কৃষক চার লাখ ৩১ হাজার ৩৫৬ টাকা ও জীবননগর উপজেলার এক হাজার ২৫০ জন কৃষক পাঁচ লাখ টাকা প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছিলেন।

বর্তমান ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সদর উপজেলায় ৩১০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় দুই হাজার ৪৮৫ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ৩১০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৪১০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এবারে সদর উপজেলার এক হাজার ১২০ জন কৃষক ছয় লাখ ২৬ হাজার ৬৪০ টাকা, আলমডাঙ্গা উপজেলার আট হাজার ৬৪০ জন কৃষক ৪৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮০ টাকা, দামুড়হুদা উপজেলার এক হাজার ৪৩০ জন কৃষক সাত লাখ ২৫ হাজার ১০ টাকা ও জীবননগর উপজেলার এক হাজার ৪১০ জন কৃষক সাত লাখ ১৪ হাজার ৮৭০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছেন।

সরিষা আবাদে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা, ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণেও ভূমিকা রাখছে সরিষা। ছবি: সারাবাংলা

৫ বছরে আবাদ বেড়েছে ২৪%, সবচেয়ে বেশি আলমডাঙ্গায়

পাঁচ অর্থবছরের সার্বিক হিসাব বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলায় সরিষা আবাদ হয়েছিল মোট দুই হাজার ৮৩৬ হেক্টর জমিতে। পরের দুই অর্থবছরে আবাদ কিছুটা করে কমেছে। তবে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টানা সরিষার আবাদ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এই দুই মৌসুমে সরিষার আবাদ হয়েছে যথাক্রমে তিন হাজার ১৩৫ ও তিন হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে। সার্বিক হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরিষার আবাদ বেড়েছে ২৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ বা প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেশি জমিতে।

অন্যদিকে চার উপজেলার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলায় সরিষার আবাদ কমেছে। সদর উপজেলায় পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৩৫০ হেক্টর জমি থেকে আবাদ নেমে এসেছে ৩১০ হেক্টর জমিতে। দামুড়হুদা উপজেলাতেও একই সময়ের ব্যবধানে আবাদ ৪০০ হেক্টর জমি থেকে নেমে এসেছে ৩১০ হেক্টর জমিতে। তবে জীবননগর উপজেলায় ৩১১ হেক্টর থেকে আবাদ বেড়ে ৪১০ হেক্টর জমিতে ছড়িয়েছে। আর আলমডাঙ্গায় এক হাজার ৭৭৫ হেক্টর থেকে বেড়ে এবারে সরিষার আবাদ হয়েছে দুই হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে। সে হিসাবে জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ সরিষাই উৎপাদন হয় এই উপজেলায়। পাঁচ বছরে এখানে সরিষার আবাদ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

কৃষকরা জানালেন, এবার টরি-৭ এবং বারি-৯, বারি-১৩ ও বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ বেশি করেছেন তারা। সাথী ফসল হিসেবে পরিচিত এই সরিষা রোপনের পর থেকে তুলতে সময় লাগে ৮৫ থেকে ৯০ দিন।

পড়ে থাকা জমিতে আবাদ

চুয়াডাঙ্গা শৈলগাড়ী গ্রামের সরিষা চাষি তাজু বলেন, ১২ কাঠা জমি পড়েই থাকে। ওই জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। এবার দেড় মণ মতো সরিষা হবে। দুহাজার টাকা খরচ হয়েছে। চার হাজার টাকা লাভ থাকবে। এরপর এই জমিতে কচুর আবাদ করব।

একই গ্রামের সরিষা চাষী আজিজুল জানান, এই সময় জমি পড়েই থাকে। তাই সরিষা লাগিয়েছি। এক বিঘায় তিন মণ সরিষা হবে আশা করছি। আবাদে খরচ হয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। ৩ মণ সরিষা উঠলে ১২ হাজার টাকার মতো দাম পাওয়া যাবে। সরিষা ওঠানোর পর এ জমিতে ধান লাগাব।

একই গ্রামের সরিষা চাষি ফজলু বলেন, ২২ কাঠা জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। সরিষা ভালো হয়েছে। তিন থেকে সাড়ে তিন মণ সরিষা হতে পারে। কৃষি অফিসার মাঠে এসে চাষাবাদ দেখাশুনা করে গেছেন। যে বীজ দেন, তা সবাই পায় না। কৃষি অফিস থেকে আরও বেশি বীজ দিলে চাষিরা তাদের পড়ে থাকা জমিতে আরও বেশি সরিষা চাষ করতে পারবেন।

ফজলুর পাশের জমিতে সরিষা আবাদ করেছেন সাদিব। তিনি বলেন, ধান আবাদের আগে এ জমিটা পড়েই থাকত। ১০ কাঠা জমিতে সরিষা চাষ করলাম। সরিষা ভালোই হয়েছে। এক থেকে দেড় মণ সরিষা হতে পারে। সরকার সহযোগিতা করলে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। সহযোগিতা পেলে অনেক পড়ে থাকা জমিতে সরিষা চাষ সম্ভব।

ভোজ্যতেলে আমদানিনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল হক জানান, চুয়াডাঙ্গার মাটি সরিষা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। টরি-৭ জাতের সরিষা বিঘায় তিন থেকে সাড়ে তিন মণ, রাই-৫ জাতের সরিষা বিঘায় সোয়া তিন থেকে সাড়ে তিন মণ, বারি-৭ ও বারি-৮ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় সাড়ে ছয় থেকে আট মণ, বারি-৯ ও বারি-১০ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় ছয় থেকে আট মণ, বারি-১১ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় সাড়ে ছয় থেকে আট মণ, বারি-১২ জাতের সরিষা বিঘায় পাঁচ থেকে ছয় মণ এবং বারি-১৩ ও বারি-১৪ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় সাত থেকে ৯ মণ পরিমাণে উৎপাদন হয়।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলাতে সরিষার আবাদ বেড়েছে। সরকারের প্রণোদনার ফলে কয়েক বছর সরিষার আবাদ বাড়ছে। আমন আবাদের শেষের দিকে রিলে পদ্ধতিতে এর চাষ শুরু হয়। ভালো জাতের সরিষা আবাদে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এভাবে তেল ফসলের চাহিদা আস্তে আস্তে পূরণ হবে।

দেশের বাইরে থেকে তেল আমদানি করতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। সরিষার আবাদ বাড়ানো গেলে তা থেকে বেশি তেল উৎপাদন করে সেই আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব বলে জানান বিভাস চন্দ্র সাহা। বলেন, এ কারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চুয়াডাঙ্গায় সরিষার আবাদ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

অধিদফতরের হিসাব বলছে, এক কেজি সরিষা ভাঙিয়ে জাতভেদে ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। দেশি সরিষা মাড়াই করে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম, টরি-৭ জাতের সরিষা প্রতি কেজি মাড়াই করে ৩৮০ থেকে ৪১০ গ্রাম, রাই-৫ জাতের সরিষা প্রতি কেজি মাড়াই করে ৩৯০ থেকে ৪০০ গ্রাম এবং বারি-৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ জাতের সরিষা প্রতি কেজি মাড়াই করে ৪৩০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে উন্নত জাতের সরিষার আবাদ বাড়ানো গেলে তাই ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব বলেই মনে করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

কৃষকরাও বলছে, আমন আবাদের পর বোরো আবাদের আগ পর্যন্ত জমি পড়েই থাকে। এই সময়ে তিন মাসের মধ্যেই সরিষার আবাদ সম্পন্ন করা সম্ভব। অনাবাদি পড়ে থাকা জমি এভাবে আবাদের আওতায় এনে সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে ভোজ্যতেলের উৎপাদন যেমন বাড়ানো যায়, তেমনি কৃষকরাও এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আরেকটি ফসল ঘরে তুলে বাড়তি উপার্জন করতে পারেন।

সারাবাংলা/টিআর

চুয়াডাঙ্গা ভোজ্যতেল সরকারি প্রণোদনা সরিষার আবাদ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দু’দিনে ভারতে ৯৯ টন ইলিশ রফতানি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৪

সম্পর্কিত খবর