Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৩ ইস্যুতে প্রচণ্ড চাপে বিএনপি

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৫২

ঢাকা: সরকার হটিয়ে ক্ষমতা লাভের চেষ্টায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে আপাতত ‘নিরুত্তাপ’ কর্মসূচির মাধ্যমে দলের অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল নিলেও গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ইস্যুতে প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপে আছে বিএনপি। ইস্যু তিনটি হচ্ছে— ১. স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ২. দলের জাতীয় কাউন্সিল এবং ৩. বিভিন্ন কারণে বহিষ্কার নেতাদের দলে ফেরানো।

দলীয় সূত্রমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর-পরই উপজেলা নির্বাচনের (প্রথম ধাপ) তফসিল ঘোষণার খবরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। জানা গেছে, দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পরিষ্কার বক্তব্য— মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরতে হলে আসন্ন উপজেলা নির্বাচসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিএনপিকে অংশ নিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের মতো এ নির্বাচন বর্জন করলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে দলটি।

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে বিভিন্ন সময় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ বা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সচারাচার যারা প্রার্থী হন, তাদের কাছ থেকে ধারাবাহিকভাবে চাপ আসতে শুরু করে। তারা স্পষ্ট করে কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়ে দেন, যেহেতু স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন হয় না, সেহেতু এই নির্বাচন নিয়ে ‘রাজনীতি’ করার কিছু নাই। এ ব্যাপারে দলের সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হলে অনেকেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

আরও পড়ুন: উপজেলা নির্বাচনে কৌশলে অংশ নেবে বিএনপি!

ইতোমধ্যে বুধবার (২৪ জানুয়ারি) নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের ২৩৩টি নির্বাচন হবে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের সাধারণ নির্বাচন একটি, শূন্য পদে উপ-নির্বাচন চারটি, পৌরসভা সাধারণ নির্বাচন তিনটি, উপ-নির্বাচন ১৫টি, ইউপি সাধারণ নির্বাচন ১৩টি, উপ-নির্বাচন ১৯০টি এবং জেলা পরিষদে উপ-নির্বাচন ৭টি। এসব নির্বাচনে অংশ নিতে হলে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে হতাশ হলেও দলীয় অখণ্ডতা রক্ষায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা খুব বেশি উচ্চ-বাচ্য করেননি। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে তারা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আশা করছেন। শুধু স্থানীয় নির্বাচন নয়, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নির্বাচনেও যেতে চান বিএনপিরপন্থী পেশাজীবী নেতারা। তারাও চান, এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসুক দল থেকে।

স্থানীয় নির্বাচনের পাশাপাশি দলের জাতীয় কাউন্সিল নিয়েও প্রচণ্ড চাপে আছে বিএনপি। দলটির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। সেটি ছিল বিএনপির ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। এরপর প্রায় আট বছর পেরিয়ে গেলেও ৭ম জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। যদিও বিএনপির গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস ও অসুস্থতা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্বাসিত জীবন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পরিবেশ নিজেদের অনুকূলে না থাকায় গত পাঁচ বছর বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি। যেহেতু তিন বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার কথা। সেই হিসেবে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের আগেই ৭ম জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের বাধ্যবাধকতা ছিল দলটির।

৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর কয়েক ধাপে নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য মিলিয়ে প্রায় ৫৯৪ সদস্যের ঢাউস কমিটি করে বিএনপি। কিন্তু বিগত দিনের আন্দোলনে কমিটির বড় বড় পদে থাকা নেতাদের খুব একটা বেশি মাঠে দেখা যায়নি। শীর্ষ পদে থাকা কয়েক ডজন নেতা কারাগারে থাকলেও সাড়ে পাঁচ শতাধিক নেতা গা বাঁচিয়ে চলেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘আঁতাত’ করে চলারও অভিযোগ উঠেছে।

এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব খোঁজার ব্যাপারে প্রচণ্ডরকম চাপ রয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধরকদের ওপর। প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে যারা রাজপথে থেকেছেন, পারিবারিক, ব্যবসায়িক এবং বৈষয়িক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, দলের জন্য ‘সীমাহীন’ ত্যাগ শিকার করেছেন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তারা চাচ্ছেন দ্রুত কাউন্সিলের মাধ্যমে তাদের মূল্যায়ন করা হোক। আর যারা পদ নিয়ে নিষ্ক্রিয় আছেন, তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক।

অবশ্য কাউন্সিলের আগে ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি ঢেলে সাজাতে হবে বিএনপিকে। সেইসঙ্গে থানা ও পৌর কমিটি গঠন করতে হবে। কারণ, এসব কমিটির শীর্ষ নেতারা পদাধিকারবলে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হন। এদের ভোটেই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের নিয়ম রয়েছে। যদিও কাউন্সিলররা তাদের হয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার দলের চেয়ারপারসনের ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে যান।

দলীয় সূত্রমতে, রংপুর বিভাগে ১০টি, রাজশাহী বিভাগে নয়টি, খুলনা বিভাগে ১১টি, বরিশাল বিভাগে আটটি, ময়মনসিংহ বিভাগে সাতটি, ঢাকা বিভাগে ১১টি, ফরিদপুর বিভাগে ছয়টি, সিলেট বিভাগে পাঁচটি, কুমিল্লা বিভাগে পাঁচটি এবং চট্টগ্রামে বিভাগে ১০টিসহ মোট ৮২টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে বিএনপির। এই ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে গত ২০২২ সাল নাগাদ মাত্র ২৮টিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পেরেছিল দলটি। বাকি ৫৪টি সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি তারা। ২০২৩ সালের পুরোটা গেছে সরকারবিরোধী আন্দোলন আর নির্বাচন সামনে রেখে নানারকম হিসাব কষার মধ্য দিয়ে।

জানা গেছে, এই মুহূর্তে বিএনপির সামনে তেমন কোনো ইস্যু নেই। বলতে গেলে সরকার পতন আন্দোলন থেকেও সরে এসেছে দলটি। সেজন্য যতদ্রুত সম্ভব জাতীয় কাউন্সিল ডেকে দল পুনর্গঠনের ব্যাপারে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে মাঠ পর্যায়ের নেতারা। বিশেষ করে ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়া নেতাদের মধ্যে কাউন্সিল নিয়ে আগ্রহ অন্যদের চেয়ে বেশি। তারা চাচ্ছেন দ্রুত কাউন্সিলের মাধ্যমে যোগ্যদের পদায়ন করা হোক।

স্থানীয়ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং জাতীয় কাউন্সিল ইস্যুর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। সেটি হলো— বিগত বছরগুলোতে নানা কারণে দল থেকে বহিষ্কার হওয়া নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে অংশ নেওয়া এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলছুট নেতাদের অথবা আওয়াম লীগ প্রার্থীদের হয়ে কাজ করায় কয়েকশ নেতাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়। এদের মধ্যে খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, কুমিল্লার সাবেক মেয়র ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কুর মতো হেভিওয়েট নেতারা রয়েছেন।

দলের ভারসাম্য রক্ষা এবং তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে এসব নেতাদের যতদ্রুত সম্ভব দলের ফেরানোর ব্যাপারে প্রচণ্ড চাপে রয়েছে বিএনপি। নানা রকম চাপ ও প্রলোভনের পরও বিএনপির যেসব বহিষ্কৃত নেতা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তাদের অতি দ্রুতি দলে ফেরানোর দাবি উঠেছে মাঠ পর্যায় থেকে। নইলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এসব পরীক্ষিত নেতা ভিন্ন পথ বেছে নিতে পারেন।

অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ এই তিন ইস্যুতে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কারাগারে রেখে এসব বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন বিএনপির জন্য। তবে, স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে দুয়েক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে দলটিকে। এটি নিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনটি ইস্যুই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, সবাইকে মাথায় রাখতে হবে কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। তারপরও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়গুলো একেক করে ফায়সালা করা হবে।’

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

অভ্যন্তরীণ বিএনপি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর