ঢাকা: চার বছর ধরে হাসিবুর রহমান হিমেলের পরিবারের গাড়িচালক ছিলেন সামিদুল। এ সময়ের মধ্যে পরিবারটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কৌশলে তাদের আর্থিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য জেনে নেন তিনি। এরপর গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর পেশাদার অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা মালেকের নেতৃত্বে উত্তরায় মিলিত হয়ে হিমেলকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, সামিদুল শেরপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাটারি বিক্রির সম্ভাবনার কথা জানান হিমেলকে। একপর্যায়ে শেরপুরে যেতে হিমেলকে আগ্রহী করেন। এরপর গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সকালে শেরপুরের উদ্দেশে রওনা দেন তারা। গাজীপুরের সালনায় এলে সামিদুল ও হিমেলকে গাড়িসহ আটকে জিম্মি করা হয়। এরপর তাদের নেওয়া হয় ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা ধোবাউড়ায়।
সেখান থেকে রাসেল ও বিল্লাল নামে দুজন গাড়িটি নিয়ে গাজীপুরের বাসন এলাকায় রেখে আসেন। এরপর পুনরায় ময়মনসিংহে চলে যান বিল্লাল। আর রাসেল উত্তরাতে হিমেলের মায়ের গতিবিধি অনুসরণ করেন।
ধোবাউড়ায় তিনদিন থাকার পর বিল্লাল ছাড়া মালেক, ছামিদুল ও অপহরণ চক্রের অন্য সদস্যরা হিমেলকে নিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তবর্তী এলাকায় যান।
এরপর রনি নামের এক ব্যক্তির সহযোগিতায় সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় হিমেলকে নিয়ে অবস্থান করেন তারা। এ সময় তারা অপহৃতকে নির্যাতন করেন। আর সেই নির্যাতনের ভিডিও হিমেলের মায়ের নম্বরে পাঠিয়ে কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন।
সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি র্যাব সদরদফতরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১, র্যাব-৯ ও র্যাব-১৪ এর দল তাহিরপুর এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ও পরিকল্পনাকারী মো. আব্দুল মালেক (৩৫), তার অন্যতম সহযোগী ও পরিকল্পনাকারী ড্রাইভার সামিদুল ইসলামকে (৩০) গ্রেফতার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে অপহৃত হিমেলকে তাহিরপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় গ্রেফতার করা হয় রনিকে (৪১)।
র্যাব বলছে, এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতন ও হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে হিমেলকে ছেড়ে দেওয়া। অপহরণে জড়িত সামিদুলকেও তারা অপহৃত হিসেবে উল্লেখ করেন।
স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের হোতা মালেক। মালেক শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয়েও অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তার নামে শুধু দেশেই রয়েছে ১৪টি মামলা। একই চক্রের সদস্য রনির বিরুদ্ধে মেঘালয়ে রয়েছে হুলিয়া বা পরোয়ানা।
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, ২৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় শেরপুর যাওয়ার সময় হিমেলকে অপহরণ করা হয়। তিনি রাজধানীর উত্তরা থাকেন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিমেল। তার বাবা ব্যাটারির ব্যবসা করতেন। চার মাস আগে বাবা মারা গেলে পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসায় নামেন হিমেল।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নিখোঁজ হলে হিমেলের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তা বন্ধ পান পরিবারের লোকজন। অনেক যোগাযোগ করেও মা তহুরা বিনতে হক ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমেলের গাড়িটি উদ্ধার করে।
এরপর অজ্ঞাত এক ব্যক্তি হিমেলের মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানায় এবং দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে তারা হিমেলকে নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়।
পরবর্তীতে হিমেলের মামা বাদী হয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় ৬ জানুয়ারি একটি অপহরণ মামলা করেন। এদিকে ছেলেকে উদ্ধারে র্যাবের কাছেও অভিযোগ করেন মা তহুরা।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতরাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে রাসেল মিয়া (৩৪) ও বিল্লাল হোসেন (২৪) নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড গুলি ও ২টি ওয়াকিটকি।
গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে কমান্ডার মঈন জানান, অপহরণ চক্রের মূলহোতা মালেক এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী চালক সামিদুল।
র্যাব জানায়, গ্রেফতাররা পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা না পেলে হিমেলের হাত-পা কেটে ফেলা ও হত্যার হুমকি দেন। গ্রেফতার মালেক বিভিন্ন সময় অপহৃত হিমেলের মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং প্রাণনাশের হুমকি দেন। পরে হিমেলের মা অপহরণকারীদের মুক্তিপণের টাকা দিতে সম্মত হন।
এরপর অপহরণকারীরা ২৩ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে তাদের আসতে বলে। বিষয়টি র্যাবকে জানান হিমেলের মা। পরে ২৩ জানুয়ারি হিমেলের মা নেত্রকোনায় পৌঁছলে মালেক ও সামিদুল তাকে তাহিরপুরে আসতে বলেন। তখন র্যাবের একটি দল তাহিরপুরে তাদের গ্রেফতার করে। এসময় র্যাবের এক কর্মকর্তাসহ দুইজন আহত হন।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাহাড়ি টিলা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় হিমেলকে। অপহরণ চক্রের সদস্য রনিকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় অপহরণ চক্রের দুই সদস্য পালিয়ে যান।