এবারের বইমেলায় থাকছে না নান্দনিকতার ছোঁয়া, কিন্তু কেন?
৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৩৯
ঢাকা: দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের জয়জয়কার চারদিকে। তবে এর সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারছে না বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা। করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি বইমেলার নান্দনিক রূপসজ্জা লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও সাধারণ দর্শনার্থীর হৃদয় হরণ করেছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে বইমেলার রূপসজ্জায় ছন্দপতন ঘটে। সেবার মেলাজুড়ে দারিদ্র্যের একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর ২০২৪ সালে এসে যেন দারিদ্র্যের ষোলকলা পূর্ণ হতে যাচ্ছে!
বইমেলা শুরুর দুই দিন আগে সোমবার (২৯ জানুয়ারি) বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্টল-প্যাভিলিয়ন তৈরির মহাকর্মযজ্ঞ চোখে পড়লেও ভেতর ও বাইরের অঙ্গসজ্জা এবং রূপবিন্যাসের কোনো তোড়জোড় বা উৎসাহপূর্ণ প্রস্তুতি দেখা যায়নি। নান্দনিক তোরণ, শৈল্পিক ডিসপ্লে বোর্ড ও চত্বর নির্দেশক এবং মনোরম দেয়াল লিখনের কাজ এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। ফলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, আর মাত্র এক দিন পর অমর একুশে বইমেলা শুরু হচ্ছে।
অথচ বিগত বছরগুলোতে বইমেলা শুরুর ১৫ দিন আগে বাংলা একাডেমির প্রবেশ পথ, প্রাঙ্গণ, পুকুর পাড়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথ, নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রধান-অপ্রধান ফটক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা, শাহবাগ মোড়, দোয়েল চত্বর এবং বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। মনীষীদের বাণী সম্বলিত ডিসপ্লে বোর্ড, তোরণ, বইয়ের অনুকৃতিতে সাজানো হয় পুরো এলাকা। বইমেলা শুরুর আগেই পুরো এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। কিন্তু এবার এগুলোর ছিটেফোঁটা চোখে পড়ছে না।
আরও পড়ুন: কলেবরে বাড়ছে না বইমেলা, পরিচালনায় এবার একাডেমি নিজেই
এই হতশ্রী অবস্থার কারণ জানতে সোমবার অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে. এম. মুজাহিদুল ইসলামের দফতরে গিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মেলা আয়োজন নিয়ে ‘চরম ব্যস্ত’ মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন আমি কিছুই বলতে পারব না। সংবাদ সম্মেলনে সব বলব। আপনি ওখান থেকে সব কিছু জানতে পারবেন।’ পরে মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘মেলায় নান্দনিকতা না থাকার বিষয়টি এখন পর্যন্ত সত্য। তবে এমনটি থাকবে না। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। মেলার উদ্বোধনী পর্বটা শেষ হলে আমরা সেদিকে নজর দেবো।’
সূত্রগুলো বলছে, সাধারণত বইমেলা শুরুর তিন মাস আগে থেকেই ইভেন্ট থিম, ইভেন্ট নিমোনিক, ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি, সাদৃশ্যপূর্ণ রঙ নির্দেশিকা বা কালার গাইডলাইন অ্যান্ড হারমনি, ক্রিয়েটিভ ভিজ্যুয়ালাইজেশন, থিমেটিক এক্সিকিউশন, ভেন্যু লেআউট ও গ্রাউন্ড প্রস্তুতি, বাংলা একাডেমির স্টল ডিজাইন, গেট ডিজাইন, ইভেন্ট ব্র্যান্ডিং, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মঞ্চ ডিজাইন ও প্রস্তুতকরণ, বইমেলার ভেতরে চার থেকে পাঁচটি মঞ্চ প্রস্তুতকরণ, স্পনসর সমন্বয়, গ্রাউন্ড ম্যানেজমেন্টসহ সম্পূর্ণ অবকাঠামো ডিজাইন, এক্সিকিউশন স্পনসরদের স্বার্থ রক্ষা, বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় সাধন, থিমের উপর ভিত্তি করে সৃজনশীল ইনস্টলেশন, পাবলিক ফাংশন ডিজাইন, প্রবেশ এবং প্রস্থান পথের ডিজাইন, ভিজিটর এনগেজমেন্ট প্ল্যানসহ সামগ্রিক প্রস্তুতি পর্ব শুরু করতে হয়। আর এ কাজগুলো করে থাকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বা এজেন্সিগুলো।
বিগত প্রায় দেড় দশক বছর ধরে অমর একুশে বইমেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে দেশের স্বনামধন্য তিন-/চারটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি। ২০১৯ বইমেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে ‘নিরাপদ ইভেন্ট’; ২০২০, ২০২১ ও ২০২৩ সালে ‘ক্রসওয়াক’; এবং ২০২২ সালে ‘সেমস’- এর মতো জায়ান্ট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো। কিন্তু এবার সরকারি প্রকিউরমেন্ট প্রথা অনুসরণ করা হয়নি। বাংকা একাডেমি কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজও দেয়নি। বাংলা একাডেমি গত সপ্তাহে সারাবাংলাকে জানিয়েছে, তারা নিজেরাই এবার মেলার আয়োজক। তবে তাদের এ সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত, আয়োজনের দৈন্যদশার কারণে সে প্রশ্ন সামনে চলে আসছে।
সূত্রগুলো বলছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিগুলোর সঙ্গে লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতা এবং বাংলা একাডেমির ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পছন্দ-অপছন্দের দ্বন্দ্বের কারণে অতীতে কাজ করা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিগুলো এবারের বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়নি। নিরুপায় হয়ে বাংলা একাডেমি নিজেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টর কাজ করছে। যদিও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা এটা করতে পারেন না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, মেলার খরচ জোগাতে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি বিজ্ঞাপনবাবদ নগদ অর্থ গ্রহণের সুযোগ বাংলা একাডেমির নেই। এ কাজটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে করতে হয়।
অভিযোগ উঠেছে, গত বছরের দেনা-পাওনা এখনো শোধ করেনি বাংলা একাডেমি। জামানতের ২৫ লাখ টাকা ফেরত পায়নি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ক্রসওয়াক। প্রতিষ্ঠানটির কর্নধার পাওনা টাকার জন্য বারবার ধরনা দিলেও তার টাকা পরিশোধ করছে না বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ২০২২ সালে জাঁকজমকপূর্ণ বইমেলা আয়োজন করা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার করেছে বাংলা একাডেমির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে ক্রসওয়াকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মারুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবারের জামানতের ২৫ লাখ টাকা ফেরত পাইনি। তাই এবার অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাইনি। কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির দিয়ে কাজটি করাচ্ছে কি না, তাও জানি না। শুনেছি, এবার নাকি তারা (বাংলা একাডেমি) নিজেরাই করছে।’
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লেনদেন নিয়ে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সাপ্লাইয়াররা অনেকে অভিযোগ করেছেন যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে তাদের পাওনা আছে। এসব অভিযোগের কারণে তাদের সঙ্গে লেনদেন সম্পন্ন করা হয়নি। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে বসব। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে দেনা-পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এজেড/এনএস