ঘুরে দাঁড়ানোর অবলম্বন খুঁজছে বিএনপি
৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:৪০
ঢাকা: নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর রাতারাতি অবস্থান বদলানোয় বেশ নাজুক অবস্থায় পড়েছে বিএনপি। রাজনীতিতে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটি ঘুরে দাঁড়াবার আর কোনো অবলম্ব খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন রাজধানীতে কালো পতাকা মিছিল ঘিরে পুলিশের হার্ডলাইন অবস্থান তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। নির্বাচন হয়ে গেলেও সরকারের কাছ থেকে যে বিন্দুমাত্র ছাড় পাওয়া যাবে না, সে বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন তারা।
দলীয় সূত্রমতে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ‘সরকার ফেলে দেওয়া’ বা ‘পদত্যাগে বাধ্য করা’র মতো অলিক স্বপ্ন আপাতত দেখছে না বিএনপি। দলটি আপাতত টিকে থাকার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সারাদেশে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা হাজার হাজার মামলা মোকাবিলা করে গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের জামিনে মুক্ত করা বিএনপির প্রথম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, টিকে থাকতে হলে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি সমমনা ও শরিক দলগুলোকে বিএনপির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং তৃতীয়ত, হতাশা দূর করে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার মতো কর্মকৌশল প্রণয়ন।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ তিনটি কাজ করে উঠতে পারলে সরকারকে চাপে ফেলার মতো কূটনৈতিক তৎপরতা ফের নতুন করে শুরু করা যাবে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। অর্থাৎ শুরু থেকে শুরু করার চিন্তা-ভাবনা করছে ব্যাকফুটে থাকা বিএনপি।
বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর থেকে পাঠানো তথ্যানুযায়ী, গত ছয় মাসে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সারাদেশে মোট ২ লাখ ৭৫ হাজার ১২৬ জন নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন, মামলা হয়েছে ১ লাখ ১৯২টির অধিক, আসামি করা হয়েছে ১০ লাখ ৬১ হাজার ৬৩ জন নেতা-কর্মীকে। ছয় মাসে আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৭৭৯ জনের অধিক নেতা-কমী, নিহত হয়েছেন ৩১ জন, ৮৪টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুণ্ডাদেশ এবং ১ হাজার ২৯৪ জনের অধিক নেতা-কমীর্কে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
দলীয় সূত্রমতে, গ্রেফতার হওয়া পৌনে তিন লাখ নেতা-কর্মীর মধ্যে অধিকাংশ-ই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে, এখনও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, আব্দুস সালাম পিন্টু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, লায়ন আসলাম চৌধুরী, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জি কে গউছ, প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পদাক ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, সহ-গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী আবুল বাশারসহ ৬০/৬৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা করাগারে রয়েছেন। বিএনপির দাবি এই মুহূর্তে কারাবন্দি নেতা-কর্মীর সংখ্যা ২৩ হাজারের অধিক।
সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতিতে নিরুত্তাপ কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে আরও কিছু দিন সময় নিতে চেয়েছিল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। নির্বাচনের পর নতুন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলকে সরকার ‘স্পেস’দেয় কি না, সেটি দেখতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু, মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) ড. মঈন খান, গয়েশ্বরচন্দ্র রায় এবং গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতাদের কালো পতাকা মিছিলে পুলিশি বাধার পর সরকারের হার্ডলাইন অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা।
মির্জা ফখরুলসহ ২৩ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে রেখে ফের আন্দোলন বেগবান করা দূরে থাক, সভা-সমাবেশ করাই যে তাদের জন্য কঠিন হবে, এটা তারা স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে। কারাগারে থাকা নেতারা মুক্তি না পেলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল নির্ধারণ করাও দলটির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত ১০ বছরের তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুই নির্বাচন (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন) বর্জন করে এবং একটিতে (২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন) অংশ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। প্রথমটিকে ‘বিনা ভোট’ দ্বিতীয়টিকে ‘রাতের ভোট’ বলে ক্যাম্পেইন চালালেও সরকারকে চাপে ফেলে পারেনি তারা। বরং বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের নানা সমালোচনা ক্ষেত্র বিশেষ গুজব এবং অপপ্রচার মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ সরকার হিসেবে পুরো মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হয়।
সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এটাকে ‘ডামি’ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। কিন্তু, এতে যে কোনো কাজ হবে না, সেটা অন্যদের চেয়ে বিএনপি কম বুঝছে না। আগামী পাঁচ বছর সরকারের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ পোষণ করছে না তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য একটা অবলম্বন দরকার বিএনপির। কিন্তু, নির্বাচনের আগে পশ্চিমাদের প্রকাশ্য সমর্থনসহ নানা অবলম্বন সামনে থাকলেও এই মুহূর্তে কোনো অবলম্বন নেই বিএনপির। তারা এখন টিকে থাকার যুদ্ধে একটা অবলম্বন খুঁজছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ১৭ বছর ধরেই বিএনপি সংকটে আছে। কিন্তু, হারিয়ে যায়নি। কারণ, বিএনপির মূল শক্তি হচ্ছে জনগণ। জনগণই বিএনপির একমাত্র অবলম্বন। জনগণকে অবলম্বন করে বিএনপি অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম