Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অতুলনীয় স্বাদ আর ঘ্রাণের হাজারী গুড়

রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৬

মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে ঝিটকার ‘হাজারী গুড়’র নাম। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হয় এই গুড়। হাতে নিয়ে চাপ দিলেই এই গুড় গুড়ো হয়ে যায়। জিভে নিলেই মিঠা স্বাদ আর গন্ধের এই গুড় জানান দেয় কেন এত সু্খ্যাতি। অতুলনীয় স্বাদ আর মনমাতানো সুগন্ধের কারণে এই গুড়ের চাহিদা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে। সুদূর ইউরোপেও ছড়িয়েছে এই গুড়ের ঘ্রাণ ও স্বাদ।

জনশ্রুতি আছে, ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথকে এই গুড় উপহার দেওয়া হয়েছিল। গুড় খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন রানি।

বিজ্ঞাপন

এই গুড় নিয়ে রয়েছে রূপকথা। জানা যায়, হাজারী কোনো বংশগত নাম নয়। এটা একজন ব্যক্তির নাম। দেড়শ বছর আগে জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকায় হাজারী প্রামানিক নামে এক গাছি ছিলেন। তিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন।

একদিন বিকেলে তিনি খেজুর গাছে হাঁড়ি বসিয়ে নামা মাত্রই এক দরবেশ এসে হাজির হন তার সামনে এবং কাঁচা রস খেতে চান তার কাছে। তখন তিনি বলেন সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসিয়েছি এতো অল্প সময়ে বড় জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাড়িতে পড়েছে তবুও দরবেশ রস খেতে চান। তখন হাজারী প্রামানিক খেজুর গাছে ওঠেন এবং দেখতে পান সারারাত ধরে যতো রস পড়তো সে পরিমাণ রসে হাড়ি ভরে গেছে। গাছি হাড়ি ভরা রস নিয়ে নিচে নেমে ওই দরবেশকে খাওয়ান।

পরে ওই দরবেশ গাছিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন, ‘কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাই খাবে এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে’ বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। এরপর থেকেই গুড়ের নামকরণ করা হয় ‘হাজারী গুড়’।

দেড়শ বছরের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে ‘হাজারী গুড়’। স্বাদ গন্ধে মন মাতানো এই গুড় উৎপাদনের সঙ্গে বংশ পরম্পরায় যুক্ত রয়েছে হাজারী পরিবার।

বিজ্ঞাপন

হাজারীর কারিগররা জানান, এ গুড়ের উৎস খেজুরের রস। কিন্তু কালের বিবর্তে খেজুর গাছের ও গুড় তৈরি কারিগর কমে যাওয়ায় খাঁটি গুড়টি পাওয়া এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। তবে গুড় তৈরির প্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।

ঐতিহ্যবাহী ‘হাজারী গুড়’কে সরকারিভাবে স্বীকৃতি স্বরূপ জেলার ব্র্যান্ডিং নামকরণ করা হয়েছে “ঝিটকার হাজারী গুড়”। বর্তমানে প্রায় ২০ থেকে ৩০টি গাছি পরিবার “হাজারী গুড়” তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।

প্রায় ৪০ বছর ধরে হাজারী গুড় তৈরি করেন আলম গাছি। তিনি বলেন, এই গুড় তৈরিতে অনেক খাটুনি হয়। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫টি গাছের রস সংগ্রহ করি। সেই রস থেকে মাত্র ৪ থেকে ৫ কেজি হাজারী গুড় তৈরি করা যায়।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন দুপুরের পর গাছে হাড়ি বেঁধে সকালের সূৰ্য ওঠার আগেই সবগুলো গাছ থেকে রস ভর্তি হাড়ি নামিয়ে বাসায় চলে আসি। এরপর ভাল করে ছেঁকে চুলায় রেখে মাটির বড় বড় পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয়। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট ঘুটে ঘুটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারী গুড়।

আলম গাছি বলেন, এই গুড় আমাদের এলাকার গর্ব। গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। প্রতি কেজি হাজারী গুড় ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এই গুড় কিনে নিয়ে যায়।

ঝিটকা এলাকার হালিম বেপারী বলেন, আমার একশ গাছ রয়েছে। সাত ভাগে এই গাছগুলো কাট হয়। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টির বেশী গাছ কাটা যায় না। প্রতিদিন তিন থেকে চার কেজি হাজারী গুড় তৈরি করতে পারি। এছাড়া লাল রঙের নাম্বারি গুড়ও তৈরি করে থাকি।

তিনি বলেন, পাইল কাটা গাছের রস দিয়ে হাজারী গুড় তৈরি করতে হয়। আর মধ্যম কাটা রস দিয়ে লাল রঙের গুড় তৈরি করি। তবে আমাদের এলাকায় দিন দিন গাছ কমে যাচ্ছে। রয়েছে গাছিরও অভাব। তাই মজুরি বেশ চড়া। ভাড়া করা একজন গাছিকে তিন মাসে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা দিতে হয়।

ঝিটকা এলকার বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন সেতু বলেন, আমাদের ঝিটকা অঞ্চল হাজারী গুড়ের কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। বড় বড় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের খুশি করতে ঝিটকা হাজারী গুড়ের জুড়ি মেলা ভার। শুনেছি ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি এই গুড় খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিলেন।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার বলেন, শুনেছি ঝিটকার ‘হাজারী গুড়’ ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকে খাওয়ানো হয়েছিল। তিনি বেশ প্রশংসাও করেছিলেন। এই গুড় মানিকগঞ্জের গর্বের। জেলার ঐতিহ্য বহন করায় সরকারিভাবে মানিকগঞ্জ জেলাকে হাজারী করে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। খেজুর গাছ কম যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী গুড় তৈরি করতে পারছেন না এখানকার গাছিরা। আশা করি এই সমস্যা আর থাকবে না।

তিনি বলেন, পুরো জেলায় পাঁচ লাখ খেজুর গাছ রোপণ করব। ঝিটকা অঞ্চলে একটি হাজারী পল্লী গড়ে তুলব। ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে সরকারিভাবে তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে।

সারাবাংলা/এনইউ

ঝিটকা মানিকগঞ্জ হাজারী গুড়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর