Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বিতর্কিত’ শাহজাহান চৌধুরী চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের নেতৃত্বে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২৩:১০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে চট্টগ্রাম জুড়ে সহিংসতায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন তিনি। সহিংসতায় জড়িয়ে তাকে অর্ধশতাধিক মামলার আসামি হতে হয়েছে, বেশ কয়েকবার কারাগারেও যেতে হয়েছে। মুক্ত থাকা অবস্থায়ও ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থেকে সহিংস রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন। ক্যাডারভিত্তিক সহিংস রাজনীতির জন্য আলোচিত-সমালোচিত এই শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম মহানগরের নেতৃত্বে এনেছে জামায়াত ইসলামী।

সাবেক এ সংসদ সদস্য নগর জামায়াতের আমির পদে নির্বাচিত হয়েছেন। কঠোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা চর্চার জন্য আলোচিত দলটির ভেতরে কোন্দল তৈরির জন্যও তিনি সমালোচিত। সাবেক আমীর আ ন ম শামসুল ইসলামের সঙ্গে প্রায় দুই দশক ধরে তার বিরোধ তুঙ্গে।

এ অবস্থায় জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হয়েই শাহজাহান চৌধুরী সরকার উৎখাতের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার হুঙ্কার ছেড়েছেন।

জানা গেছে, শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম মহানগর শাখা জামায়াত ইসলামীর আমির নির্বাচন করা হয়। সর্বশেষ গ্রেফতারের পর আড়াই বছরেরও বেশিসময় ধরে কারাগারে থাকা এই নেতা গত ১৭ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান। দলের ভেতরে তার অনুসারীরা এরপরই তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে তৎপর হয়ে ওঠেন। কেন্দ্র থেকেও মহানগরের দায়িত্বশীলদের ওপর এ ব্যাপারে চাপ আসে। এর ফলে আড়াই দশক পর ‘বিতর্কিত’ এ নেতাকে নগর জামায়াতের আমীরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা শাহজাহান চৌধুরী নব্বই দশকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় এবং মহানগরে বিশাল ক্যাডারবাহিনী গড়ে তোলেন। এরপর প্রায় তিন দশক ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত কমপক্ষে ৩০ জনকে হত্যার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

১৯৯১ সালে শাহজাহান চৌধুরী চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, যে আসনটি একসময় বামপন্থিদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী বিএনপি নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অলি আহমদ তাকে হারিয়ে আসনটির নিয়ন্ত্রণ নেন। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট হলেও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় দল দু’টির অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসনটি জামায়াত ইসলামীকে ছেড়ে দিলেও অনড় অবস্থান নেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য অলি আহমদ। অলিকে মানাতে না পেরে বিএনপি আসনটি উন্মুক্ত রাখে। এর ফলে অলি আহমদ ধানের শীষ এবং শাহজাহান চৌধুরী দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। কিন্তু শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচনে অলিকে হারিয়ে চমক তৈরি করেন।

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী জরুরি অবস্থায় দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনের অযোগ্য হন শাহজাহান চৌধুরী, যিনি চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন। এ প্রেক্ষাপটে দৃশ্যপটে আসেন নগর জামায়াতের তৎকালীন আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে আ ন ম শামসুল ইসলাম জামায়াতের মনোনয়ন পান। কিন্তু তুমুল বিরোধিতায় নামেন শাহজাহান চৌধুরী ও তার অনুসারীরা। সেই প্রথম জামায়াতের কোন্দল প্রকাশ্যে আসে। দলের একাংশের বিরোধিতার মধ্যেও শামসুল জিতে আসেন।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার শুরু হয়। তখন সেই বিচার ঠেকাতে চট্টগ্রামে মাঠে নামেন শাহজাহান ও শামসুল দুজনই। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নগরী ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়াসহ প্রায় পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দেয়। পুলিশের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত চলে।

জামায়াতের তৃণমূল স্তরের নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকানোর আন্দোলনে শামসুল নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শাহজাহান চৌধুরী কট্টর ভূমিকা নিয়ে নাশকতায় নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায়ের পর চট্টগ্রাম জুড়ে চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, যার পুরোটাই শাহাজাহানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সংঘটিত হয়।

এ অবস্থায় শাহজাহান চৌধুরী ও আ ন ম শামসুল ইসলাম উভয়ই গ্রেফতার হয়ে একাধিকবার কারাগারে যান। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে জামায়াত ঘরানার আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভীকে দলে টেনে প্রার্থী করেন।

সূত্রমতে, তখন জামায়াতের অভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগ নিয়ে শাহজাহান চৌধুরীর প্রভাব ও শক্তি ব্যবহার করেন নদভী এবং অনায়াসে জিতে আসেন। এর ফলে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েন শামসুল। সীতাকুণ্ডে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। নদভী দ্বিতীয় দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শামসুলকে সেখান থেকেও ‘আউট’ করেন, যার পেছনে শাহজাহান চৌধুরীর ইন্ধনের অভিযোগ আছে।

শাহজাহান চৌধুরী ও আ ন ম শামসুল ইসলামের বিরোধ সামলাতে না পেরে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম মহানগর ‍জামায়াতের আমির পদে পরিবর্তন আনা হয়। শামসুলকে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির করে কক্সবাজার জেলা জামায়াতের তৎকালীন আমির ও ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ শাহজাহানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম নগরের আমিরের দায়িত্ব। শামসুলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুহাম্মদ শাহজাহান।

সূত্রমতে, আমির শাহজাহান দায়িত্ব নিয়ে দু’নেতার বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা আসে শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং ও হালিশহর) আসনে এবং শামসুলকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় রাজি করানোর জন্য। কিন্তু আমির শাহজাহান একাধিকবার বৈঠক করেও সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হন। শাহজাহান চৌধুরী কোনোভাবেই রাজি হননি।

দুই নেতার বিরোধের প্রভাব পড়ে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ছাপিয়ে চট্টগ্রামে জামায়াতের সামগ্রিক রাজনীতিতেও। সেই দ্বন্দ্বের জেরে দুই নেতা চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি থেকে তাদের পদ হারান।

এর মধ্যে জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারায়। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে আবার শামসুলকে প্রার্থী করে, বিএনপি তাকে ধানের শীষ প্রতীকে দেয়। তিনি নদভীর কাছে হারেন।

শাহজাহান চৌধুরী সর্বশেষ গ্রেফতার হন ২০২১ সালের ১৪ মে। ওই বছরের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদ আন্দোলনে হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে শাহজাহানকে গ্রেফতার করা হয়। আড়াই বছরেরও বেশিসময় পর গত ১৭ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান।

গত একদশক ধরে অব্যাহত নাশকতা-সহিংসতা, মামলা-গ্রেফতারের মধ্যে ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থাকা জামায়াত ইসলামীর চট্টগ্রামের দায়িত্বশীল নেতারা কেউই প্রকাশ্যে আসেন না। গণমাধ্যমকেও এড়িয়ে চলেন। এর ফলে তাদের পাঠানো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া দলটির নেতাদের কারও বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের অন্তঃত তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে সারাবাংলা, যাদের কেউই নাম প্রকাশে রাজি হননি।

এদিকে শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম মহানগরের আমীর করার পর শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন নবনির্বাচিত আমির শাহজাহান চৌধুরী এবং সঞ্চালনায় ছিলেন নায়েবে আমীর আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ। প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান।

আমির হিসেবে শাহজাহান চৌধুরীর প্রথম কর্মসূচিতে আ ন ম শামসুল ইসলামও ছিলেন, যিনি এখন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির পদে আছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ ও মুহাম্মদ শাহজাহানসহ কমিটির আরও কয়েকজন নেতা ছিলেন।

সভায় বর্তমান সরকারকে উৎখাতের আন্দোলন জোরদারের তাগিদ দিয়ে শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ৯৩ শতাংশ মানুষ জামায়াত ইসলামীসহ বিরোধী দলের ওপর আস্থা রেখেছে। সেই আস্থা রক্ষা করে জালেম, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, ইসলামের দুশমনদের উৎখাতের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’

সারাবাংলা/আরডি/একে

আমির চট্টগ্রাম জামায়াত জামাায়াতে ইসলামী টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর