Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাহাড়ে ফের উত্তেজনা, ২ মাসে ৮ খুন

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:২৩

রাঙ্গামাটি: হঠাৎ করেই ফের উত্তেজনা বাড়ছে পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলায় পৃথক দুই ঘটনায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ছয় কর্মী নিহতের পর এবার রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে একই সংগঠনের আরও দুজন প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে দুই মাসের মাথায় রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের আট নেতাকর্মী খুন হলেন।

খাগড়াছড়ির দুটি হত্যাকাণ্ডে ছয়জন খুনের ঘটনায় ইউপিডিএফ ভেঙে গড়ে ওঠা ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করলেও এবার রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি দুই কর্মী হত্যাকাণ্ডে খোদ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছে ইউপিডিএফ। প্রতিপক্ষরা অবশ্য এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ক্রমশ মিত্র হারাচ্ছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই ইউপিডিএফ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাহাড়ের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠা এই সংগঠনটি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে ‘নিঃসঙ্গ’ হয়ে পড়েছে।

সর্বশেষ আজ রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) ইউপিডিএফের দুই কর্মী খুনের ঘটনায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে ঘটনাস্থল রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মাচালং ব্রিজ পাড়ায়। এলাকাটি আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নে।

আরও পড়ুন- এবার বাঘাইছড়িতে ইউপিডিএফে’র দু’জনকে গুলি করে হত্যা

রোববারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করে ইউপিডিএফ রাঙ্গামাটি জেলা শাখা এক বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে এই শাখার সংগঠক সচল চাকমা বলেন, ‘আজ দুপুর ১২টার সময় জেএসএস সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সাজেক ইউনিয়নের মাচালং ব্রিজ পাড়ায় একটি দোকানে এসে অতর্কিতভাবে ইউপিডিএফের দুই সদস্যের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারে ঘটনাস্থলে দীপায়ন চাকমা ও আশুক্য চাকমা ওরফে আশীষ নামে দুই ইউপিডিএফ সদস্য নিহত হন।’

হত্যার ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত’ ও ‘ন্যাক্কারজনক’ আখ্যায়িত করে সচল চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাামে জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ে ইউপিডিএফের চলমান আন্দোলন বানচাল করে দেওয়ার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সন্তু গ্রুপসহ ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত ইউপিডএফ নেতাকর্মীদের হত্যা করছে।’

দুই মাসে ৮ খুন

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের অনিলপাড়ায় গুলি করে ইউপিডিএফের চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ওই সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহসভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন ত্রিপুরা।

পানছড়ির চার খুনের দেড় মাসের মাথায় গত ২৪ জানুয়ারি জেলার মহালছড়ি উপজেলায় আরও দুজনকে হত্যা করা হয়। তখন মারা যান ইউপিডিএফ সদস্য রবি কুমার চাকমা ও শান্ত চাকমা ওরফে বিমল। সবশেষ আজ ৪ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় আরও দুজন খুন হলেন। নিহত হলেন ইউপিডিএফ সদস্য দীপায়ন চাকমা ও আশুক্য চাকমা ওরফে আশীষ (৪৫)। এ নিয়ে দুই মাসের মাথায় পাহাড়ে ইউপিডিএফের আট নেতাকর্মী প্রাণ হারালেন প্রতিপক্ষের গুলিতে।

বাঘাইছড়ির জোড়া খুনের ঘটনায় ইউপিডিএফ অভিযোগ তুললেও তা অস্বীকার করে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বাঘাইছড়ি থানার সাংগঠনিক সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা বলেন, ‘সাজেকে জেএসএসের সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই। ইউপিডিএফের অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

এর আগে খাগড়াছড়ির দুই খুনের ঘটনায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেছিলেন, পানছড়ি ও মহালছড়িতে ইউপিডিএফ কর্মী হত্যার ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তিনি ইউপিডিএফের ছয় কর্মী নিহতের ঘটনায় ‘দুঃখপ্রকাশ’ও করেছিলেন।

রোববারের দুই হত্যাকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘বাঘাইছড়ির মাচালং এলাকায় নিহত দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ খাগড়াছড়ি জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলা হবে এবং ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করা হবে।’

নেতৃত্বহীন করার জন্য হত্যাকাণ্ড?

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন পঁচাত্তরে জাতীয় চার নেতা, পাহাড়ে মিঠুন চাকমা, বিপুল চাকমাদের হত্যাকাণ্ড— এই সবই নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে ঘটিত। জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। আমরা যদি পেছন ফিরে দেখি— কুমিল্লার তনু হত্যা, পাহাড়ে কল্পনা চাকমা অপহরণসহ রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হচ্ছে না। সারাদেশের মতো পাহাড়েও বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চলছে।’

অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা-খুন অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ ও এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আগে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কিছুটা আস্থা থাকলেও এখন সেই আস্থা আর নেই। পুলিশও রাষ্ট্রের হয়ে পক্ষপাত করছে। এসব খুন-গুম-হত্যা, নিরাপত্তাহীনতাই বলে দেয়, পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দিকে।’

এর আগে সম্প্রতি সারাবাংলা ডটনেটের সঙ্গে আলাপচারিতায় রাঙ্গামাটির এসপি মীর আবু তৌহিদ বলেছিলেন, ‘রাঙ্গামাটি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আছে। এখানকার অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় রয়েছে। কোনো ধরনের নৈরাজ্য হলে আমরা আইনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করব।’

২০২৩ সালেও ২৫ ‘হত্যা’

চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ২০২৩ সালজুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনায় একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফ প্রতিবেদনে দাবি করে, ২০২৩ সালে পাহাড়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছিলেন ২৫ জন। এই সময়ে গ্রেফতারের শিকার হন ৪৯ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২১ জন, অপহৃত হন ৪৩ জন এবং যৌনসহিসংতার শিকার হন ২৩ জন নারী-শিশু।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘সমতলের চেয়ে পাহাড়ের বেশিসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত। তারপরও কদিন পরই পাহাড় অশান্ত হয়, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বলতে গেলে একটা রুটিনওয়ার্ক হয়ে গেছে। এত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকা সত্ত্বেও আমরা সাধারণ মানুষ কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? রাষ্ট্রকে এটা আমলে নিতে হবে এবং আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।’

সারাবাংলা/টিআর

ইউপিডিএফ জেএসএস পাহাড়ে খুন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর