কাটতে চায় সবাই, রিটে টিকে আছে যশোর-বেনাপোল সড়কের গাছ
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:১০
যশোর: মামলায় আটকে আছে যশোর বেনাপোল সড়কের গাছের ভাগ্য, সেই সঙ্গে আটকে আছে সড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মাত্র ৬৯০টি মৃত-অর্ধমৃত ও অতি পুরাতন ঝুঁকিপূর্ণ গাছের কারণে সড়কটির ‘ফোর লেন’ হওয়ার পথ বন্ধ রয়েছে বছরের পর বছর। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদসহ উন্নয়নে ‘আগ্রহী’ সবাই গাছগুলি অপসারণের পক্ষেও অবস্থান নিলেও পরিবেশবাদীদের করা রিট পিটিশনের কারণে স্থগিত হয়ে আছে সবকিছু।
সড়ক বিভাগের এস্টেট আইন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ খান জানান, সরেজমিন পরিদর্শন ও গাছের কারণে বিভিন্ন ক্ষতি, ঝুঁকি, প্রাণহানিসহ নানা দিক উল্লেখ করে তৈরি করা প্রতিবেদনেও ওই গাছ না রাখার পক্ষে মতামত দেওয়া হয়। একইসঙ্গে পরিবেশবাদীদের করা রিটের স্থাগিতাদেশ বাতিলও চাওয়া হয় প্রতিবেদনে। এত কিছুর পরও সবই থমকে আছে।
যশোর-বেনাপোল ৩৮.২০ কিলোমিটারের মহাসড়কটি সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে যাওয়া-আসা ও আন্তর্জাতিকভাবে ভারত থেকে পণ্য আনা-নেওয়া, আমদানি-রফতানির একমাত্র মহাসড়ক। এটি এশিয়ান হাইওয়েরও করিডোর।
রাষ্ট্রীয়ভাবে, আন্তর্জাকিভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে এই মহাসড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সড়ক দিয়েই লাখ লাখ শরণার্থী যেমন ওপারে ভারতে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছে, তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করার জন্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীসহ সব সহায়তা এই পথ দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর ১১ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবাসী সরকারের যে প্রথম জনসভা যশোরে হয়েছিল সেদিনও নেতারা এই পথ দিয়েই যশোরে এসেছিলেন।
এত ঐতিহ্যবাহী সড়কটি অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথও সুগম করছে। সড়ক বিভাগ এটিকে ‘ফোর লেন’ বিশিষ্ট মহাসড়কে রূপান্তরের কাজ শুরু করতে যায় কয়েকবছর আগে। এতে বাঁধ সাধেন পরিবেশবাদীরা। সড়কের পাশের ‘বৃক্ষগুলি ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে’ দাবি করে পরিবেশবাদীদের পক্ষে একটি রিট পিটিশন (৮২৩/২০১৮) করা হয় গাছ না কাটার জন্যে। এরপরই আদালত গাছ কাটার বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন।
বছরের পর বছর ধরে এ নিয়ে বিভিন্ন দফতর, বিভাগ, সরকারি কর্মকর্তাও সংশ্লিষ্ট দফতর বারবার চেষ্টা করেও রিট পিটিশনের বিপরীতে স্থাগিতাদেশ বাতিল চেয়েও কোনো সুরাহা করতে পানেনি। সর্বশেষ গত বছর নভেম্বরে ওই মামলার শুনানি হলেও তার কোনো ফল বা পরবর্তী তারিখও জানতে পারেনি সড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের এস্টেট আইন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ খান ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যশোর বেনাপোল সড়কটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং ৮ ফেব্রুয়ারিতে দীর্ঘ প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরিদর্শনের সময় তার সঙ্গে ছিলেন, যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ, জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান, সহকারী বন সংরক্ষক অমিত মণ্ডল, উপ বন সংরক্ষক আবুল কালাম ও জি এম মোহাম্মদ কবির, বিভাগীয় বৃক্ষপালনবিদ বিপ্লব কুণ্ডু, সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানসহ অন্যরা।
সূত্রমতে এই প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, ‘কিছু গাছ সড়কের উপর ঝুঁকে আছে, বাস ট্রাক কাভার্ড ভ্যানের ঘর্ষণে বাকলসহ গাছের অর্ধেক অংশই নেই, যানবাহনগুলি সড়কের মাঝামাঝি চলাচল করে, যেকোনো সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। অধিকাংশ গাছে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, মৃতগাছও রয়েছে, তার ডালপালা ভেঙে বড় ধরণের ক্ষতিও হতে পারে। অনেক গাছ পাকা পেভমেন্টের মধ্যে হওয়ায় মাঝে মাঝে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। অর্ধমৃত, মৃত, ঝুঁকিপূর্ণ এবং গাছে গর্তসৃষ্টি হওয়ায় গাছগুলো অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং ৮২৩/২০১৮ মামলাটি খারিজ করা প্রয়োজন।’
ওই প্রতিবেদনে গাছগুলোর জন্যে বিভিন্ন সময়ে হতাহতের ঘটনা, আম্ফানে উপড়ে পড়ার পরও অপসারণ না হওয়া, গাছ ও ডাল ভেঙে সড়ক দুর্ঘটনা,মানুষের জীবন ও সম্পদ নষ্ট হওয়ার বিষয়ও উল্লেখ করে গাছ অপসারণের পক্ষে যুক্তি ও মত দেওয়া হয়। সর্বশেষ কলামে ৬৯০টি গাছ কেটে ফেলার পক্ষেও সুপারিশ করা হয়।
এর আগে, যশোর জেলা প্রশাসন সড়ক বিভাগের সচিবকে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্তকরণে সম্পর্কিত যে পত্র দেয় তাতেও মানুষের জানমালের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে গাছ কাটা ও অপসারণের পক্ষে মতামত দেয়।
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘সড়ক বিভাগ সব সময় সরকারের উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছে। উন্নয়নের স্বার্থে এবং ফোর লেন করতে এই গাছ অপসারণ প্রয়োজন বলেই বিভাগের আইন কর্মকর্তা মতামত দিয়েছেন। বিভিন্ন সভায় আমরা এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট দফতরে জানিয়েছি। গত নভেম্বরেও কোর্টে এ ব্যাপারে শুনানি ছিল, আর কোনো ফল পাইনি বা জানা যায়নি।’
যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘গাছগুলি ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক, প্রাণহানির কারণ হচ্ছে। বেশিরভাগ গাছই এখন অকেজো ও অপ্রয়োজনীয়। সড়ক প্রশস্তকরণ, উন্নয়ন ও জানমালের নিরাপত্তায় সেগুলির অপসারণ আমরাসহ জড়িত সব পক্ষই বলছে। কিন্তু আদালতের নির্দেশই সব পথ বন্ধ করে রেখেছে।’
সারাবাংলা/এমও