প্রাণহীন লিটল ম্যাগ চত্বরের করুণ দশা
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:১২
ঢাকা: অমর একুশে বইমেলার লিটল ম্যাগ চত্বর গত কয়েকবছরের মতো এবারও প্রাণহীন। এই চত্ত্বরে এখনও চালু হয়নি বহু স্টল। পাঠক ও দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। তবে লিটল ম্যাগের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। কেউ কেউ প্রিয় সময় বন্দি করছিলেন ক্যামেরায়। লিটল ম্যাগ চত্ত্বরে কবিতা ও ছড়া নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন কবি, ছড়াকার ও পাঠকরা। রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) মেলার এগারতম দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে লিটল ম্যাগ চত্বরে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে এবার লিটল ম্যাগকে স্থান দেওয়া হয়েছে। বিকেল ৪টার দিকে মেলায় প্রবেশ করতেই দেখা গেল লিটল ম্যাগ চত্বর প্রায় ফাঁকা। বরাদ্দ নেওয়া হলেও বহু স্টল এখনও সাজানো হয়নি, সেখানে নেই কোনো বই, ফাঁকা পড়ে রয়েছে স্টল। কোনো কোনো স্টলে শিশুতোষের নামে একেবারেই নিম্নমানের বই রাখা হয়েছে, যা লিটল ম্যাগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও নয়।
নব্বইয়ের দশক থেকে সাহিত্যচর্চায় নতুন ধারা উসকে দেওয়া লিটল ম্যাগ আন্দোলন যেমন ধীরে ধীরে প্রাণ হারিয়েছে, বইমেলার লিটল ম্যাগ চত্বরও যেন তারই প্রতীকী রূপ ধারণ করেছে।
মেলা প্রাঙ্গণে কথা হলে লিটল ম্যাগাজিন ‘নোঙর’ এর প্রকাশক সুমন শামস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমি বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান নিয়ে যতটা চিন্তা করে লিটল ম্যাগ নিয়ে তাদের সেই চিন্তা নেই। মেলা যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে এলো তখন থেকেই দেখছি একেক বছর লিটল ম্যাগকে একেক জায়গায় রাখা হয়। মেলার যে ডিজাইন করা হয়, প্রতিবছর পরিবর্তন করা হয়, ডিজাইনের লে আউটটা কেমন হবে তা আমাদের দেখানো হয় না। আমাদের কোনো প্রতিনিধিকেও সেখানে রাখা হয় না। স্টলের যে লটারি হয় সেখানেও আমাদের রাখা হয় না। বাংলা একাডেমি আমাদেরকে অবহেলা করে, প্রধানমন্ত্রী যখন বইমেলা উদ্বোধন করেন, সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও লিটল ম্যাগের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর এমন একটি জায়গা লিটল ম্যাগকে দেওয়া হলো, প্রতিটি প্রকাশকই এই জায়গাটি নিয়ে অসন্তুষ্ট। দুটি স্টলে একটি করে বাল্ব দেওয়া হয়েছে, সন্ধ্যার পরে স্টলগুলো অন্ধকার থাকে। পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যায় না। নতুনদের বাংলা একাডেমি যদি ভালো চোখে, স্নেহের চোখে না দেখে, তাহলে এই ছোটরা যে বড় হবে, বড় হলে তারা একই ধরনের চর্চাটা করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দাবি জানিয়েছি, মেলার মাঝখানে লিটল ম্যাগটাকে রেখে স্টলগুলো যেন সাজানো হয়। আমাদের যদি ক্ষুদ্রভাবেই দেখা হয় ভবিষ্যতে হয়ত লিটল ম্যাগের প্রকাশকরা মেলায় অংশ নেবে না।’
এই প্রকাশক আরও বলেন, ‘এ বছরও ৮ থেকে ১০ টি নতুন লিটল ম্যাগ এসেছে। যারা লিটল ম্যাগের পাঠক তারা এসে খোঁজে খোঁজে বইটি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো প্রকাশক তাদের প্রকাশনা বিক্রিও করতে চায় না। কারণ এটি একটি আন্দোলন, এটি একটি চর্চা।’
লিটল ম্যাগকে রক্ষায় বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের প্রণোদনা দিতে পারে। সম্পাদক ও প্রকাশকদের অনুপ্রাণিত করতে প্রতিবছর লিটল ম্যাগকে পুরষ্কার দিতে পারে। ওয়ার্কশপ বা সেমিনার হতে পারে। যেভাবেই লিটল ম্যাগকে এগিয়ে নিতে হবে।’
জানতে চাইলে লিটল ম্যাগ প্রতিবুদ্ধিজীবী’র প্রকাশক সাদাত উল্লাহ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি লিটল ম্যাগের কোনো করুণ অবস্থা দেখি না। বাংলাদেশে জ্ঞান-বিদ্যা ও জ্ঞান চর্চা প্রায় অন্ধকার যুগে রয়েছে। দিন দিন লেখকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, জ্ঞান বিদ্যার পরিবেশ একমুখী হয়ে যাচ্ছে। এখন বই প্রকাশ পাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও আমলাদের। যার টাকা ও ফেসবুকে খ্যাতি রয়েছে তারাই বই প্রকাশ করছে। সেখানে লিটল ম্যাগের এই অবস্থা হবে এটিই স্বাভাবিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকাশনা শিল্প এখন বাণিজ্যের অংশ হয়ে গেছে, কিন্তু লিটল ম্যাগ সে পথে হাঁটে না। তাই লিটল ম্যাগ করুণ অবস্থায় রয়েছে সেটি আমি বিশ্বাস করি না। বরং লিটল ম্যাগ দেশের শিল্প-সাহিত্যের প্রকৃত করুণ চিত্র তুলে ধরছে।’
বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত বাহনই হলো লিটল ম্যাগাজিন। এ ধরনের প্রকাশনা অনেকটা অনিয়মিত ও অবাণিজ্যিক। লিটল ম্যাগ নামে পরিচিত এসব ম্যাগাজিন প্রতিনিধিত্ব করে একটি ছোট সমমনা নব্য গোষ্ঠীর যাদের চিন্তা-ভাবনা-দর্শন চলমান ধারা থেকে ভিন্ন এবং অভূতপূর্ব। শিল্পসাহিত্যে লিটল ম্যাগ একটি আন্দোলনের নামও।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধ্বে ইউরোপ-আমেরিকায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু। বঙ্গদেশে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন প্রবর্তন করে প্রমথ চৌধুরী। তার সম্পাদিত সবুজপত্রকে (১৯১৪) আধুনিক লিটল ম্যাগাজিনের আদিরূপ বলে গণ্য করা হয়। অবশ্য অনেকে মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২) বাংলা ভাষায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিন।
সূচনা যেটিই হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যচর্চায় লিটল ম্যাগাজিন একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে আশি ও নব্বইয়ের দশকে লিটল ম্যগাজিনে যুক্ত হয়ে পড়েন তরুণ কবি-লেখকদের বড় একটি অংশ।
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে