খুলছে রাজশাহী-মুর্শিদাবাদ নৌপথ, সক্রিয় মাদক কারবারিরা
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪২
রাজশাহী: রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে নৌবাণিজ্যের পথ খুলছে। সেজন্য প্রস্তুত গোদাগাড়ী নৌবন্দর। এখন কেবল উদ্বোধনের পালা। উদ্বোধন হলেই সুলতানগঞ্জ থেকে ময়া পর্যন্ত রুটে চলাচল করবে নৌযান। তবে ইতোমধ্যে এই নৌবন্দর ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠছে মাদক কারবারিরা। তারা বন্দরটির আশপাশে দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুলতানগঞ্জ ঘাট থেকে কিছুটা দূরেই শুরু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। সেখান থেকে শুরু মহানন্দা নদী। এই এলাকাকে বলা হয় নদীর মোহনা। নদীর ওপারে চর আলাতুলি। সুলতানগঞ্জের আশেপাশে আছে অনেক মাদক কারবারির বাড়ি। এমনকি এই এলাকায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পথ দিয়ে হেরোইন, ফেনসিডিল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদসহ প্রবেশ করে নানান মাদকদ্রব্য। এই রুট দিয়ে সবচেয়ে বেশি আসে হেরোইন। ভারতের মাদক কারবারিরা নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে গোদাগাড়ীকে। বাংলাদেশের কারবারিদের জন্যও রুটটি নিরাপদ। এখান থেকে সহজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে মাদক।
মাদক পাচারে সবচেয়ে নিরাপদ রুটগুলো হলো- গোদগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ, মানিকচক, কানাপাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কোদালকাটি, আলাতুলি, ঝাইলাপাড়া, ক্লাবঘাট প্রভৃতি। এই এলাকাগুলো সুলতানগঞ্জের কাছাকাছি। এখান থেকে মাদক এসে ঢুকে যাচ্ছে গোদাগাড়ী পৌরসভার সিঅ্যান্ডবি, গড়ের মাঠ, মাদারপুর, হাটপাড়া, রেলওয়ে বাজার, কুঠিপাড়া, শিবসাগর ও বারুইপাড়া এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব এলাকায় প্রায় অভিযান পরিচালনা করে। তবে রাঘব-বোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, ভারত থেকে মাদকদ্রব্য এনে নিজ অথবা অন্যের বাড়িতে ভাড়া হিসেবে রাখেন তারা। পরে সুযোগ বুঝে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। আর এ কাজে যুক্ত করা হয় স্কুল, কলেজ, মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী, গরুর রাখাল, সুন্দরী তরুণী-কিশোরী ও গৃহবধূদের। মূলত তাদের দিয়েই পাচার করা হচ্ছে মাদকদ্রব্য। এসব মাদক ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। মাদকদ্রব্য পাচার ও কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার মানুষ।
মাঝে-মধ্যে চুনোপুঁটির মতো কয়েকজন মাদককারবারি গ্রেফতার হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে রাঘব বোয়ালরা। মাদক কারবারে জড়িয়ে কোটিপতি হয়েছেন কয়েকশ ব্যবসায়ী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় নাম আছে প্রায় ২০০ জন কারবারির। এর মধ্যে আছে- চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা এবং কথিত ব্যবসায়ীও রয়েছেন। অনেক মাদক কারবারি জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছেন। এদের শত শত এজেন্ট কাজ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জকে ঘিরে ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে মাদক কারবারিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, এখানে নৌ-বন্দর হলে এর দখল যেতে পারে মাদক কারবারিদের হাতে। তারা পণ্য পরিবহনের আড়ালে সহজে মাদকবহন করতে পারবে। বৈধ ব্যবসার আড়ালে চালাবে অবৈধ ব্যবসা। এছাড়াও অনেকে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট নিয়ে মাদকের ব্যবসা করতে পারে বলে আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
তবে মাদক ব্যবসায়ীদের ছাড় দিতে রাজি না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা মাদকের বিরুদ্ধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, এখানকার মাদক কারবারিরা এখনও সক্রিয়। সুলতানগঞ্জ এলাকায় তাদের ইটভাটাও আছে। খাস জমি দখল নিয়ে এসব ইটভাটা তৈরি করেছে তারা। এছাড়াও পরিবহনের ব্যবসায় যুক্ত আছেন বেশ কয়েকজন মাদক কারবারি।
স্থানীয় কৃষক আবদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুলতানগঞ্জ এলাকায় আছে অনেক মাদক কারবারি। পুলিশের তালিকায়ও তাদের নাম রয়েছে। পুলিশ তাদের কখনও ধরতে আসে না। এখানে নৌ-বন্দর হলে তারা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে। এর পেছনে স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করবে। কারণ, জনপ্রতিনিধিরা এর দখল নিতে পারলে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা পাবেন তারা।’
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মাদক নিয়ন্ত্রণ সভা আছে। নৌ-বন্দর নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। কোনো মাদক কারবারি যেন ঘাটের দখলে না থাকে সেদিকে আমরা খেয়াল রাখব। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের দৃষ্টিও থাকবে। কেউ নিতে চাইলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজশাহী পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মাদক কারবারিদের ছাড় দেব না। গোদাগাড়ীতে নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করে মামলাও দেওয়া হচ্ছে। তবুও অনেকেই জামিনে বের হয়ে আসছেন। কিন্তু বেশি হেরোইন নিয়ে যারা ধরা পড়ছে তাদের জামিন হচ্ছে না। আমার আশাবাদী গোদাগাড়ী থেকে অচিরে মাদক কারবারিরা নির্মূল হবে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জিল্লুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুলতানগঞ্জ মাদক পাচারের একটি চিহ্নিত পয়েন্ট। সেখানে নৌ-বন্দরকে ঘিরে মাদক কারবারিরা সক্রিয় হয়ে উঠতে চাচ্ছে। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছি। সোমবার প্রতিবেদনটি সুরক্ষা বিভাগে পাঠানো হবে। ইতোমধ্যে আমাদের গোয়েন্দারা সেখানে নজরদারি শুরু করেছেন। অন্য সংস্থাগুলোও নজরদারি বাড়াবে।’
তিনি জানান, নৌ-বন্দর নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে। কেউ যেন মাদক নিয়ে দেশের অন্য স্থানে পৌঁছাতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। সেইসঙ্গে সীমান্তেও নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।
সারাবাংলা/পিটিএম