ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব, দেড় দশকে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১৭
ঢাকা: গত ১৫ বছরে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কোনো কোনো ফলের উৎপাদন বেড়েছে ৪০০ গুণও! ড্রাগনসহ বাহারি সব বিদেশি ফল এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওপর অর্ধেক বোঝা কমিয়ে নওগাঁ আবির্ভূত হয়েছে আমের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে। দেশে মাল্টা ও কমলার উৎপাদনও লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। কাজুবাদাম ও কফির আবাদ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দেশীয় ফলের মধ্যে আম ও কাঁঠাল এখন সারাবছরই উৎপাদন হচ্ছে।
কৃষি ও খাদ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তথ্য বলছে, মাত্র এক দশক আগেও দেশে জনপ্রতি ফলগ্রহণের পরিমাণ ছিল গড়ে মাত্র ৩৫ গ্রাম। ২০২২ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ গ্রামে। এর পেছনে রয়েছে সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশে নীরবে ঘটে চলেছে ফল বিপ্লব। এতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে দেড় দশক ধরে চলা বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প। ফলের উৎপাদন বাড়াতে এর বাইরে ভূমিকা রাখছে আরও কয়েকটি প্রকল্প।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ সারাবাংলাকে বলেন, দেশে ফলের উৎপাদন বাড়াতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কৃষিবান্ধব বলেই এই সরকারের আমলে দেশে ফলের উৎপাদন এতটা বেড়েছে। এখন বাজারে যেমন দেশি ফল পাওয়া যায়, বিদেশি ফলও এখন দেশে উৎপাদন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে কৃষক ও কৃষিকে উৎসাহিত করেন, অন্য সরকারের আমলে তা আমরা দেখিনি। সে কারণেই এই সাফল্য।
মন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান আমলে আমরা ছাত্র ছিলাম। তখন দুই টাকার আঙুর কিনলে মানুষ তাকিয়ে থাকত। এখন মানুষ কয়েক কেজি আঙুর কিনতেও কার্পণ্য করে না। এখন বাংলাদেশ ফুলে-ফলে পূর্ণ। সারাবছরই কোনো না কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে। দেশের কৃষিতে এটি একটি বড় পরিবর্তন।
বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ফল আবাদে এলাকা ও মৌসুম সম্প্রসারণকে ফল উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় নিয়ামক হিসেবে দেখছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একসময় আম বলতে শুধুমাত্র রাজশাহীর আমই বোঝানো হতো। এখন সাতক্ষীরা, নওগাঁ ও পাহাড়ি অঞ্চলে আম চাষ হচ্ছে। সারাদেশেই বাণিজ্যিকভাবে আমের আবাদ হচ্ছে। এখন সারাবছর পেয়ারা হয়। বলসুন্দরী কুল, আপেল কুল ও বাউকুল— মৌসুমে এ ধরনের বড়ই ব্যাপক আকারে পাওয়া যাচ্ছে। এখন মৌসুমি ফলের উৎপাদন অনেক বেশি।’
বিদেশি ফল আবাদের প্রসঙ্গ টেনে আসাদুল্লাহ বলেন, ‘পাঁচ থেকে সাত বছর আগে দেশে ড্রাগন ফল আবাদের কথা চিন্তাই করা যেত না। সেটি এখন সম্ভব হয়েছে। কমলায় আমরা এতটা সফল না হলেও মাল্টা আবাদে বেশ সফলতা মিলেছে। এসব সম্ভব হয়েছে সরকারি নানা উদ্যোগ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের চলমান বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে।’
অধিদফতরের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিকাভাবে দেশে বিভিন্ন ফলের আবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ায় চাষিরা ফল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এখন সারাবাছর কোসেনা না কোনো ফল পাওয়া যায়। এখন আর আপেল বাইরে থেকে আমদানি না করলেও চলবে, আপেলের স্থান দখল করে নিয়ে পেয়ারা ও কুল। সরকারের নীতি সহায়তার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আরেক সাবেক মহাপরিচালক মো. এনামুল হক বলেন, “১৯৯৬ সাল থেকেই দেশে কাজি পেয়ারা ও আম্রপালি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করি। ২০০১ পর্যন্ত আমি দায়িত্বে থাকাকালীন নতুন অনেক সম্ভামনাময় ফল চাষে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করেছি। সেই সময় স্লোগান ছিল, ‘কাজী পেয়ারা ভালো ফল, খেলে দেহে বাড়ে বল’। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন কর্মসূচি গ্রহণ করে দেশে ফলের উৎপাদনকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শুধু মধুমাসে ফল খাওয়ার প্রথা ভেঙে গেছে। এখন সারাবছর কিছু না কিছু ফল থাকছেই, মানুষের পুষ্টির জোগান হচ্ছে দেখে এই আশি বছর বয়সেও এক অন্য রকম প্রশান্তি পাই। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুবই জরুরি।’
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা চাই দেশে ফল উৎপাদন বাড়ুক। বিদেশি ফলের আমদানি কমুক। প্রতিবছর দেশে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। ফল আমদানির পরিমাণ এখন দিনে দিনে কমছে। দেশেই এখন নতুন নতুন বিদেশি ফল উৎপাদন হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, দেশের টাকা দেশেই থাকবে।
তিনি আরও বলেন, তবে যেসব ফল বাংলাদেশে একেবারেই উৎপাদন সম্ভব নয়, যেমন খেজুর ও আঙুর— সেগুলো তো আমদানি করতেই হবে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, দেশে উৎপাদিত ফল বেশি সতেজ থাক। দুটি বড়ই একটি কমলার সমান পুষ্টি দিয়ে থাকে। তাই দেশের স্বার্থে দেশীয় ও মৌসুমী ফল গ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফরের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশে আমের উৎপাদন ছিল মাত্র ১২ লাখ টন। ২০২৩ সালে তা ২৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে আম্রপালি, হিমসাগর, হাড়িভাঙা ও বারি-৪ জাতের নতুন আম। এসব জাতের আম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবাদের ফলে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে উৎপাদন।
কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় আম বাগানের মালিকদের নানা ধরনের সহায়তাও দিচ্ছে সরকার। আম রফতানিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ মৌসুমে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে চার হাজার টন আম রফতানি হয়েছে। বারোমাসি জাতের আভির্ভাবের ফলে এখন সারাবছরই দেশ আম পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে দেশে মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে ড্রাগন ফলের আবাদ বেড়েছে ১১৬ গুণ। বিস্ময়কর হলেও সত্য, দেশে ফলটির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪০০ গুণ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ১৮ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলেছিল ৬৬ টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড দুই হাজার ৯৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয়েছে। এ বছর ড্রাগনের উৎপাদনেও হয় নতুন রেকর্ড— ২৫ হাজার ৭৬০ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে পেয়ারার উৎপাদন ছিল তিন লাখ টনের কিছু বেশি, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা চার লাখ ৩০ হাজার টন ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তিন বছর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে মাল্টার আবাদ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। একই সময়ে উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। আর কুলের উৎপাদন যেখানে কয়েক বছর আগেও এক লাখ টনের কিছু বেশি ছিল, এখন তা দুই লাখ টন ছুঁইছুঁই করছে।
২০২২ সালের খানা জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে ফল গ্রহণের মাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৮ গ্রাম। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০০ গ্রামে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ২০০ গ্রামে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, দেশে এখন সারাছরই আম ও কাঁঠাল পাওয়া যায়। কাটিমন আম বারো মাসেই উপাদন হয়। বারি-৬ জাতের কাঁঠালও বারোমাসি। মৌসুমের বাইরেও দেশীয় ফল যেন সারাবছর পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যেই আমরা বারোমাসি ফলের জাতগুলোকে প্রকল্পের পক্ষ থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
মেহেদী মাসুদ আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে এখন আমরা ফলসহ নানা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে মাথাপিছু ফল গ্রহণের মাত্রা আমরা ২০০ গ্রামে নিয়ে যেতে চাই, যা এখন প্রায় ১০০ গ্রাম। লক্ষ্য পূরণে প্রকল্প থেকে সব ধরনের কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দেশীয় ফল পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প পুষ্টি প্রকল্প ফল উৎপাদন বছরব্যাপী ফল উৎপাদন বারোমাসি ফল